একটি উন্নত দেশে যেখানে বছরে এ রোগে একটি শিশু মারা যায়, সেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মৃত্যু ঘটে ২০০ শিশুর। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বছরে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। আক্রান্তের দিক থেকে বাংলাদেশ পঞ্চম স্থানে রয়েছে। বর্তমানে দেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ৬০ লাখ পেরিয়ে যাবে। এর মধ্যে প্রতি বছর ৫ বছরের কম বয়সী কমপক্ষে ৫০ হাজার শিশু মারা যায়।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, নিউমোনিয়া প্রতিরোধে টিকা প্রদান ও সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা গেলে দেশে নিউমোনিয়ায় অকালমৃত্যু অনেকাংশে কমানো যাবে।
সংশ্লিষ্ট বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে এখনো সরকারিভাবে নিউমোনিয়ার সবগুলো ভ্যাক্সিন (টিকা) আনা সম্ভব হয়নি। এমনকি টিকা পাওয়ার জন্য আবেদনও করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। দেশের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) সূত্রে জানা গেছে, হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি (হিব)-এর টিকা সরকারিভাবে দেয়া হলেও নিউমোকক্কাসের টিকা দেয়া হয় না। এখন পর্যন্ত যে ১৫টি দেশ নিউমোকক্কাস কনজুগেট ভ্যাকসিন (পিসিডি) পাওয়ার জন্য গ্যাভি এলায়েন্সের অনুমোদন পেয়েছে সেই তালিকায় স্থান হয়নি বাংলাদেশের। তবে বেসরকারি পর্যায়ে নিউমোকক্কাস টিকা পাওয়া যায়। প্রতিটির দাম ৭০০-১০০০ টাকা। দামি হওয়ায় মধ্যবিত্তের পক্ষেও এ টিকা নেয়া সম্ভব হয় না । অথচ গরিব জনগোষ্ঠীর মাঝে এরোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। সরকারি পর্যায়ে এ টিকা আনা সম্ভব হলে অতি অল্প দামে দেয়া সম্ভব হতো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. খন্দকার সিফায়েতউল্লাহ শীর্ষ নিউজ ডটকমকে বলেন, নিউমোনিয়ার টিকা পাওয়ার ব্যাপারে গ্যাভি-র অনুমোদনের জন্য আবেদনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।
টিকা পাওয়ার জন্য আবেদনের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চেয়ে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির ভারপ্রাপ্ত প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. জহুরুল হকের সাথে কথা বললে তিনি জানান, গ্যাভি সমর্থক দেশগুলোর জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণপূর্বক বছরে দুবার নিউমোনিয়ার টিকা পেতে আবেদনের অনুমতি দেয়া হয়। বাংলাদেশ এখনো অনুমতি পায়নি। অনুমতি পেলে আগামীতে আবেদন করা হবে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, শীতকালে শুষ্ক আবহাওয়ায় প্রকৃতিতে ভাইরাসের বিচরণ বেশি থাকে। এসব ভাইরাস শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে। ফলে সর্দিকাশি ও জ্বরের প্রকোপ দেখা দেয়। ভাইরাসজনিত এসব সর্দি-জ্বর অনেকদিন থাকলে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না নিলে এ থেকে নিউমোনিয়া দেখা দিতে পারে।
নিউমোনিয়া সম্পর্কে ঢাকা শিশু হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. প্রবীর কুমার সরকার শীর্ষ নিউজ ডটকমকে বলেন, নিউমোনিয়া মূলত বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত একটি রোগ। স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনি, হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা ও ভাইরাসজনিত কারণে নিউমোনিয়া হয়ে থাকে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে ফুসফুসে এর প্রভাব পড়ে। বুকে কফ বাড়ে, ফলে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। আক্রান্ত রোগীকে যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা দেয়া হলে এ রোগ শতভাগ নিরাময়যোগ্য। অন্যথায় রোগীর মৃত্যু অনিবার্য।
সারাবিশ্বের নিউমোনিয়া পরিস্থিতিও রীতিমতো আঁৎকে ওঠার মতো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর বিশ্বে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রতি ১৫ সেকেন্ডে মারা যায় ১টি শিশু । বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়া ৫ বছরের কম বয়সী মোট ১ কোটি শিশুর মধ্যে ২০ শতাংশ মারা যায় এ রোগে।
আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী এ রোগে ৪০ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে। এর মধ্যে ১৬ থেকে ২২ লাখ শিশু তীব্র শ্বাসতন্ত্রজনিত সংক্রমণে মারা যায়, যার প্রায় ৩০ শতাংশ শিশুই বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার। ম্যালেরিয়া, হাম ও এইডস রোগে মৃত্যুর চেয়ে এ রোগে মৃত্যু ঘটে বেশি। প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৫ হাজার যুবক-যুবতী এ রোগের কারণে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। অথচ নিউমোনিয়া প্রতিরোধ ও আক্রান্তদের সঠিক চিকিৎসা দিতে পারলে সারাবিশ্বে প্রতি বছর কমপক্ষে ১০ লাখ প্রাণ নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব।