ডায়াবেটিস চিকিৎসায় তিনটি ব্যাপার অপরিহার্য। ১. খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ২. ব্যায়াম ৩. ওষুধ। ১ ও ২নং পালন না করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রায় অসম্ভব। ১ ও ২নং পালন করার আসল উদ্দেশ্য হল ওজন স্বাভাবিক রাখা।
ডায়াবেটিসের ওষুধ : ট্যাবলেট
চারভাবে কাজ করে।
■ সিক্সেটগগ, সালফোনিলুরিয়া। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের রোগীদের শরীরে ইনসুলিন থাকে যতটুকু সেটা প্রয়োজনের তুলনায় কম। সিক্রেটগগ, সালফোনিলুরিয়া-প্যানক্রিয়াসকে স্টিমুলেট করে যেটুকু ইনসুলিন পাওয়া যায় তা নিঃসরণ করায়।
গ্লাইবেনক্লামাইড, গ্লিক্লাজাইড, গ্লিমিপ্রাইড, গ্লিনাইডস এ ধরনের ওষুধ; ক্রিয়েটিনিন স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ হলে, লিভারের অসুখ থাকলে এগুলো নিষেধ। সবগুলোই দিনে একটা সর্বোচ্চ ডোজ আছে যার বেশি দিলে আর কাজ করে না। এই অবস্থাকে বলে সেকেন্ডারি ফেইলুর। তখন ইনসুলিন দিতে হয়। তাই ৮০ মি.গ্রামের গ্লিক্লাজাইড ৫ মিলিগ্রামের গ্লাইবেনক্লামাইড বা ২ মিলিগ্রামের গ্লিওমিপ্রাইড ট্যাবলেট ৪টার বেশি দিয়ে লাভ নেই। গ্লিনাইডসগুলো ২-৪ ঘণ্টা কাজ করে। এগুলো মিল রিলেটেড বা খাবারের সঙ্গে যে গ্লুকোজ বাড়ে সেটা কমায়।
■ সেনসিটাইজার : টাইপ-২ ডায়াবেটিসের আরেকটা কারণ হল ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স অর্থাৎ শরীরে পর্যাপ্ত ইনসুলিন থাকলেও ইনসুলিন কাজ করে না। মেটফরমিন ও গ্লিটাজনগুলো এই রেজিস্ট্যান্স কমায় বা ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বাড়ায়; এদেরও একটা সর্বোচ্চ ডোজ আছে; কিডনি, লিভারের অসুখ থাকলে দেয়া যায় না। মেটফরমিন কিডনি নষ্ট করে না তবে কিডনি দুর্বল হলে মেটফরমিন দেয়া যায় না।
■ একারবোজ জাতীয় ওষুধগুলো খাদ্যনালী থেকে গ্লুকোজকে রক্তে যেতে দেয় না।
■ এনক্রেটিন মাইমেটিকস- (গ্লিপটিনস, গ্লুটাইডস) নতুন এ ওষুধগুলো প্যানক্রিয়াসের কোষগুলোকে মরতে দেয় না, তাত্ত্বিকভাবে তাই এরা ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সাহায্য করে। খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যনালিতে এক ধরনের হরমোন নিঃসরণ হয় যেটা প্যানক্রিয়াসে গিয়ে ইনসুলিন নিঃসরণ করে। গ্লুটাইডসগুলো সরাসরি প্যানক্রিয়াসে গিয়ে ইনসুলিন নিঃসরণ করে। গ্লিপটিনসগুলো গ্লুটাইডকে ভাঙতে দেয় না। গ্লুটাইডস ইনজেকশন আকারে পাওয়া যায়, এরা দারুণভাবে ওজন কমায়। গ্লিপটিনস ব্যয়বহুল, ট্যাবলেট আকারে পাওয়া যায়। এরাও ওজন কমায়। নতুন এ ওষুধগুলো প্যানক্রিয়াসের কোষগুলোকে মরতে দেয় না, তাত্ত্বিকভাবে তাই এরা ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সাহায্য করে। মেটফরমিন একারবোজ, গ্লিপটিনস জাতীয় ওষুধে খাদ্যনালীর সমস্যা (বমি, ডায়রিয়া, ফ্লাটুলেন্স-গ্যাস) হতে পারে। সেজন্য এগুলো খাবারের সঙ্গে বা ভরা পেটে খেলে ভালো।
মানুষের শরীরে দুইভাবে গ্লুকোজ বাড়ে। ১. খাওয়ার সঙ্গে ২. অভুক্ত অবস্থায় লিভার থেকে আসে। এজন্য মেটফরমিন রাতে খাওয়া ভালো এবং সকালের সুগারের ওপর ভালো কাজ করে। কারণ মেটফরমিন লিভার থেকে গ্লুকোজ বের হতে দেয় না। এছাড়া মেটফরমিন শরীরে গ্লুকোজ ব্যবহার কমায়, খাদ্যনালী থেকে রক্তে (অ্যাবজরপশন) যাওয়া ঠেকায়, সেজন্য মেটফরমিন মেজর মিলের সঙ্গে খাওয়া যায়। একারবোজ, গ্লিপটিনস ও গ্লিটাজন জাতীয় ওষুধে হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তে গ্লুকোজ স্বাভাবিকের নিচে নেমে যাওয়া) করে না। এরা ওজন বাড়ায় না। গ্লাইবেনক্লামাইড, গ্লিক্লাজাইড, গ্লিমিপ্রাইড ওজন বাড়ায়। গ্লিমিপ্রাইড সারাদিনে একবার খেতে হয় (সিঙ্গেল ডোজ)। গ্লাইবেনক্লামাইড, গ্লিক্লাজাইড ২টার বেশি লাগলে ২ ভাগ করে খেতে হয়; কোন মতেই দিনে তিনবার ডোজ নয়। এক্স আর, এমআর, এস ্আর ট্যাবলেটগুলো দিনে একবার (সিঙ্গেল ডোজ) খাওয়ার জন্য।
মেটফরমিন একারবোজ, গ্লিপটিনস, গ্লিটাজনগুলো গ্লাইবেনক্লামাইড, গ্লিক্লাজাইড, গ্লিমিপ্রাইড-এর সঙ্গে কম্বিনেশনে খাওয়া যায়। মেটফরমিনের ট্যাবলেটগুলো সাইজ বড় হলেও এদের পাওয়ার যে সালফনিলুরিয়ার চেয়ে কম তা অনেকে জানে না। কিডনি নষ্ট করে ধারণায় অনেকেই মেটফরমিন খেতে চায় না; আসলে কিডনি দুর্বল হলে মেটফরমিন খাওয়া যায় না। যাদের কিডান ভালো তাদের জন্য মেটফরমিন বেস্ট ওষুধ।
গ্লাইবেনক্লামাইড, গ্লিক্লাজাইড, গ্লিমিপ্রাইডগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা কম্বিনেশনে খাওয়া যায় না। এগুলো ইনসুলিনের সঙ্গে ব্যবহার করলে বেশি (সিনারজিস্টিক) অ্যাকশন পাওয়া যায় না। তাই ইনসুলিন শুরু করলে এগুলো আস্তে আস্তে বাদ দিতে হবে।
গ্লিটজেনগুলো ওজন বাড়ায়, এগুলো ব্যবহার করলে শরীরে পানি জমে যায়। গ্লিটাজন হার্টের অসুখ বাড়ায়, তাই ইউরোপে এটা নিষেধ হয়ে গেছে।
ডায়াবেটিস : ল্যাবরেটরি ডায়াগনোসিস
রক্তের স্বাভাবিক গ্লুকোজ : নাস্তার আগে-৬ মিমোল/লি: বা তার কম; খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর ৭.৮ মিমোল/লি: বা তার কম
প্রি-ডায়াবেটিস : নাস্তার আগে -৬.১ মিমোল/লি: থেকে ৬.৯ মিমোল/লি:। খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর-৭.৮ থেকে ১১.১ মিমোল/লি:।
ডায়াবেটিস : নাস্তার আগে ৭ মিমোল/লি: ও ৭-এর বেশি; খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর ১১.১ মিমোল/লি: ও তার বেশি।
কেন এই বিভক্তিকরণ
প্রি-ডায়াবেটিকদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে তিনগুণ বেশি। প্রি-ডায়াবেটিকদের ম্যাক্রোভাস্কুলার জটিলতা (গ্যাংগ্রিন, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক) হওয়ার সম্ভাবনা ডায়াবেটিস রোগীদের অনুরূপ। তাই কারও ব্লাড গ্লুকোজ ৬.৩ মিমোল/লি: বা ৯.৩ মিমোল/লি: হলে অবশ্যই গ্লুকোজ খেয়ে টেস্ট (ওজিটিটি) করতে হবে।
কীভাবে চিকিৎসা শুরু করা যায়
প্রথমে ডায়াগনোসিসের পর অধিকাংশ ডায়াবেটিস রোগীই মন খারাপ করে যেটা অস্বাভাবিক নয়; প্রথমেই ইনসুলিন দিতে চাইলে রোগীর আপত্তিও বেশি থাকে।
কাদেরকে ইনসুলিন দিতেই হয়
গর্ভবতী মহিলা, অনেক বেশি সুগার, কিটোনুরিয়া, সার্জারি ও ডায়াবেটিসের ইমার্জেন্সি থাকলে ইনসুলিনের বিকল্প নেই।
কাদের ট্যাবলেট দেয়া যায় না
ডায়বেটিসের ইমার্জেন্সি, প্রেগনেন্সি, টাইপ-১ ডায়াবেটিকদের ইনসুলিন দেয়া যায় না। অপারেশনের আগে, পরে মেটফরমিন, পায়োগ্লিটাজন বাদ দেয়া ভালো।
কখন ওষুধ শুরু করবেন
একজনের খাওয়ার পরে সুগার হল ৭.৫। ভয়ে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করলেন এই বুঝি ডায়াবেটিস হয়ে গেল বলে, আবার নাস্তার আগে ৬.৮, খাওয়ার পরে ৭.৪ দ্বিধাদ্বন্দে পড়লেন কি করবেন। এসব পরিস্থিতিতে হিমোগ্লোবিন এ১সি সহায়ক হবে। হিমোগ্লোবিন এ১সি ৬.৫% বা তার বেশি হলে অন্য রিপোর্ট যাই হোক চিকিৎসা শুরু করতে হবে, বিশেষ করে লাইফ স্টাইল বদলাতে হবে। যদি স্থূলকায় হয় মেটফরমিন দিতে হবে। মেটফরমিন ওজন কমানোর ওষুধ হিসেবেও ব্যবহƒত হয়। মেটফরমিন ডায়াবেটিস প্রতিরোধক হিসেবে প্রি-ডায়াবেটিকদেরও দেয়া হয়। হিমোগ্লোবিন এ১সি ৭ এর বেশি হলে ওষুধ শুরু করতে হবে।
কখন ইনসুলিন দেবেন
আগে থেকে চিকিৎসা পাচ্ছে এমন রোগীর হিমোগ্লোবিন এ১সি ৮.৫% হলে তার ইনসুলিন লাগবে। হিমোগ্লোবিন এ১সি ৯.৫% হলে ইনসুলিন ছাড়া চলবেই না। নতুন ডায়াবেটিকদের বেলায় এটা প্রযোজ্য নয়।
নিয়ন্ত্রণের মানদণ্ড
নাস্তার আগে ৬ মি.মোল বা তার কম; খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর ৮ মি.মোল থেকে কম। হিমোগ্লোবিন এ১সি-৬.৫ থেকে ৭.০%. রক্তের হিমোগ্লোবিন এ১সি দেখে রক্তে পূর্ববর্তী তিন মাসের গ্লুকোজের অবস্থা বোঝা যায়।
জিডিএম (জিস্টেশনাল ডায়াবেটিস ম্যালাইটাস-গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস)
গর্ভবতী মায়েদের নাস্তার আগে ৫.৩ মি.মোল, খাওয়ার ১ ঘণ্টা পরে ৭.৮ মি.মোল, খাওয়ার ২ ঘণ্টা পরে ৬.৭ মি.মোল-এর বেশি হলে বোঝা যায় গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হয়েছে।
হাইপোগ্লাইসেমিয়া
রক্তের গ্লুকোজ স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলে তাকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বলে।
যারা কোন ওষুধ ব্যবহার করে না ওইসব ডায়াবেটিকদের হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয় না। হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে প্রথমে খুব ক্ষুধা লাগবে-দুনিয়া খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা
করবে, গা কাঁপবে, গা ঘামবে তারপর অজ্ঞান হয়ে যাবে। যারা রোগী এবং পরিচর্যাকারী তাদের হাইপোগ্লাইসেমিয়া সম্পর্কে জানতে হবে। যারা ট্যাবলেট খায় বা
ইনজেকশন
নেয় তাদের সবারই হাইপোগ্লাইসেমিয়া সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। ইনসুলিন
যারা নেয়, সালফনিলুরিয়া ট্যাবলেট
যারা খায় সেসব ডায়াবেটিকের হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়। মেটফরমিন, একারবোজ, পায়োগ্লিটাজন, ভিলডাগ্লিপটিন জাতীয় ওষুধ গ্লুকোজ কমিয়ে স্বাভাবিক করে; তবে স্বাভাবিকের নিচে বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া করে না।
প্রত্যেক মানুষেরই রাত তিনটার দিকে ব্লাড গ্লুকোজ সব চেয়ে কম থাকে। যারা ওষুধ নেয় সেব ডায়াবেটিক রোগীর রাতে শোওয়ার সময় কিছু খেয়ে শোয়া ভালো।
কখন কী পরীক্ষা করাবেন
নিয়মিত গ্লুকোমিটারে বাসায় রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। মাসে অন্তত একবার ল্যাবরেটরিতে সুগার পরীক্ষা করতে হবে। সব ডায়াবেটিকদের তিন মাসে একবার হিমোগ্লোবিন এ১সি, লিপিড প্রফাইল (নাস্তার আগে করতে হবে), ৬ মাসে একবার ইউরিনে অ্যালবুমিন, বছরে একবার হার্ট ও চোখ পরীক্ষা করানো উচিত।
লেখক : ■ অধ্যাপক ডা. খাজা নাজিম উদ্দীন
মেডিসিন বিভাগ, বারডেম