মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন

মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন
মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন
॥ ই-হেলথ২৪ ডেস্ক ॥  বিশ্বব্যাপী মানসিক রোগীর সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৪৫ কোটি। এই সংখ্যা থেকে বলা যায়, মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব আজ আর নতুন করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। মানসিক স্বাস্থ্যকে বিশ্বব্যাপী প্রাধান্য দেবার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল অনেক পূর্বে । সেই ধারাবাহিকতায় এ বছর ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেন্টাল হেলথ’ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় মানসিক স্বাস্থ্য : চিকিৎসা সম্প্রসারণ ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন।’

বিশ্ব স্বাংস্থ্য সংস্থার সহায়তায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট দিবসটি পালনে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টস। বেসরকারি পর্যায়েও গ্রহণ করা হয়েছে নানা উদ্যোগ।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুটি প্রধান কারণে বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে-প্রথমত এদেশে ১৬.১% ভাগ মানুষ ভুগছে কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায়, বিপরীতে মনোরোগ চিকিৎসক ও তার সহযোগী পেশাজীবীদের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখে ০.৪৯ জন করে (অর্থাৎ প্রায় ২ লাখ মানুষের জন্য মাত্র ১ জন করে) রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী। মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী বলতে বোঝানো হচ্ছে বিশেষজ্ঞ সাইকিয়াট্রিস্ট, মনোচিকিৎসায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, নার্স, সাইকিয়াট্রিক স্যোশাল ওয়ার্কার, অকুপেশনাল থেরাপিস্টসহ অন্যরা । আবার প্রতি ১ লাখ জনগোষ্ঠির জন্য সাইকিয়াট্রিস্ট রয়েছে মাত্র ০.০৭৩ জন অর্থাৎ প্রায় ১৫ লাখ মানুষের জন্য গড়ে ১ জনেরও কম। সাইকোলজিস্টসহ অন্যদের সংখ্যাও অত্যন্ত অপ্রতুল। সারাদেশে বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে যতগুলো সাইকিয়াট্রিক শয্যা রয়েছে, দেখা যাচ্ছে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য আছে ০.৫৮টি করে শয্যা ।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবকাঠামো অত্যন্ত মজবুত সাংগঠনিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, এদেশের মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার মান তৃতীয় বিশ্বের যেকোনো রাষ্ট্রের জন্য ঈর্ষণীয়। তাই মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত এক বিশাল অংশের (১৬.১%) সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে এই অবকাঠামোকে ব্যবহার করতে হবে।

বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্যের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করলে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের দাবী রাখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ-এর সুপারিশ এবং আমাদের নিজস্ব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সমন্বিত মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য নিচের বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে:

জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন-এর ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যকে বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান করা দরকার। সরকারি দায়বদ্ধতার পাশাপাশি সাধারণ জনগণ, উন্নয়ন সংস্থা এবং বেসরকারি সংস্থাসমূহকেও এ বিষয়ে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে।

মানসিক রোগ বিষয়ে যে ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত রয়েছে তার অবসানকল্পে এবং মানসিক রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যে বৈরি সামাজিক আচরণ করা হয় তার সংশোধনের জন্য জনমত গঠন এবং বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে এ সম্পর্কে পাঠক্রম চালু করা দরকার। ৬ষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীর পাঠ্যসূচিতে মানসিক ও মাদকাশক্তি বিষয়ের অন্তর্ভুক্তির কাজ চলছে। কাজটি যেন থেমে না যায়, মনে রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে।

মাঠ পর্যায়ে যারা স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে থাকেন- কম্যুনিটি ক্লিনিকের চিকিৎসক, মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট, ফার্মাসিস্ট, নার্স, স্বাস্থ্য সহকারী, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ও অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিলে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় এর অন্তর্ভুক্তি সফল ও বাস্তবানুগ হতে পারে। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মাঠপর্যায়ের কর্মীরা সরকারের নানা কর্মসূচী বাস্তবায়নে নিয়োজিত থাকেন ণ্ড এসকল কাজের পাশাপাশি তাদেরকে মানসিক রোগ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে যাতে তারা অন্যকে সচেতন করতে পারেন এবং সমন্বিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অতি প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দেন।

২০০৯ সালের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে ৫০ শয্যার অত্যাধুনিক মাদকাসক্তি নিরাময় ইউনিট এবং একই দিনে মানসিক স্বাস্থ্যের গবেষণার উন্নতিকল্পে এই হাসপাতালেই চালু হচ্ছে কেন্দ্রীয় ডিজিটাল লাইব্রেরী। আগামীতে এই ইনস্টিটিউটের সকল সেবাকার্যক্রম ও প্রশাসনকে আধুনিকায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ করে ‘ই-মেন্টাল হেলথ’ পরিসেবা চালু করার স্বপ্ন দেখি আমরা।

এবছরের মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে আমাদের অংগীকার হোক ণ্ড বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও সহজলভ্য, সময়োপযোগী, জনবান্ধব এবং বিজ্ঞানভিত্তিক করে গড়ে তোলা এবং সেই লক্ষ্যে মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার অন্তর্ভূক্ত করার জন্য যার যার সাধ্যানুযায়ী মেধা-মনন ও শ্রমের বিনিয়োগ করা। এর জন্য প্রয়োজন সর্বস্তরের জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ।

মানসিক স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গে অবধারিতভাবে চলে আসে মাদকাসক্তির কথা। মাদকাসক্তি একদিকে ধ্বংস করছে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে, তৈরি করছে নানাবিধ মানসিক ও সামাজিক সমস্যা। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে পরিবারের সদস্যদের রয়েছে নানা লুকোছাপা, চিকিৎসা নিয়ে আছে নানা সীমাব্ধতা। তাই আমাদের মেধাবী ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মাদকের করালগ্রাস থেকে বাঁচাতে মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে আরো বেশি নজর দিতে হবে । মাদকের বিস্তার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে অবশ্যই মাঠ পর্যায়ে অর্থাৎ প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় মাদকাসক্তি নিরাময় ও প্রতিরোধের প্রাথমিক ধারণাও অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। ফলে বিজ্ঞান ভিত্তিক মাদকাসক্তি নিরাময়ের চিকিৎসা ব্যবস্থা হবে সম্প্রসারিত এবং উন্নতি ঘটবে মানসিক স্বাস্থ্যের।

মানসিক স্বাস্থ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ শিশু মানসিক স্বাস্থ্য। জন্মের সময় অসাবধানতা, অপুষ্টি, শৈশবের নানা রোগের সংক্রমণ, মাথায় আঘাত এবং জন্মগত নানা ত্রুটি এবং শিশুর প্রতি পরিবারের সদস্যদের যথোপযুক্ত আচরণ না করার কারণে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে। এই শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নানা বিভ্রান্তির পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন সংস্থার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা। সাধারণ অসহায় মানুষের আবেগকে পুঁজি করে শিশু মানসিক স্বাস্থ্যকে স্বাস্থ্য সেবাখাত থেকে আলাদা রাখার অংশ হিসেবে শিশুর বিভিন্ন মানসিক সমস্যাকে দেখানো হচ্ছে যে সেটা কোনো রোগ নয়। এভাবে প্রকৃত চিকিৎসাসেবাপ্রাপ্তি নানাভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। এই অবস্থা দূর করার জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা এবং সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ । কেবলমাত্র প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় মানসিক স্বাস্থ্যকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে সেটি অর্জন করা সম্ভব।

আচরণগত সমস্যার কারণে রোগী নিয়ে অনেক অভিভাবকরা প্রথমে আসেন হেলথ সেন্টারে। কিন্তু সেখানে সমস্যা শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। স্বাস্থ্য সেবাদানকারীতে প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে এমনটি ঘটে থাকে। এটি ক্লিনিক্যাল বাধা। দৈহিক স্বাস্থ্য সেবাদানকারী এবং মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। দেহ-মন যদিও একসূত্রে গাঁথা, মনকে আলাদা করে রাখার কারণে এমনটি ঘটছে। এটি হচ্ছে আর্গানাইজেশনাল বাধা। নীতি নির্ধারণী এবং অর্থনৈতিক বাধাও রয়েছে প্রকটভাবে। এসব বাধা দূর করে মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার আর কোনো বিকল্প উপায় নেই। এই অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে রোগীদের চিকিৎসার ব্যয়ভার কমে যাবে, সহজে সেবা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত হবে। সর্বোপরি রোগীদের মানবাধিকার রক্ষা করা সম্ভব হবে। অন্যথায় অমানবিক পরিস্থিতির শিকার হতেই থাকবে মানসিক রোগীরা।

এ বছরের মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে আমাদের অংগীকার হোক- প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় মানসিক স্বাস্থ্যের অন্তর্ভুক্তির জন্য স্ব স্ব অবস্থানে থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা করা।

ড. মোহিত কামাল
মনোচিকিৎসক ও কথাসাহিত্যিক
drmohitkamal @yahoo.com

Exit mobile version