ট্যাবলেট ঔষধ প্রযুক্তির নানা কথা

মাহফুজ আল মেহেদী
ট্যাবলেট নামক বস্তুটির সাথে আমরা সবাই-ই পরিচিত। যখনই রোগে আক্রান্ত হই তখনই এই বিশেষ বস্তুটির আমদের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না এটি কি, কোথা থেকে আসল, কি দিয়ে তৈরি। কিভাবে তৈরি , আর এটির কাজই বা করে কিভাবে এমন নানা কিছু।

ট্যাবলেট কি ?
এটি একটি সলিড (কঠিন) ডোজেজ ফরম যা এক বা একাধিক মূল উপাদান বা ড্রাগ এবং কিছু এক্সিপিয়েন্ট বা ফিলার (যা ট্যাবলেটটিকে একটি আকার প্রদানে সাহায্য করে) দিয়ে তৈরি। এটি মুখের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়। ব্যবহারের নানা রকম সুবিধা থাকার সুবাদে ঔষধ প্রযুক্তিতে এটি সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

ট্যাবলেট সৃষ্টির ইতিহাস
১৮৪৩ সালের ডিসেম্বর এক ব্রিটিশ নাগরিক ইউলিয়াম ব্রোকডন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন। যার মাধ্যমে পাউডার জাতীয় উপাদানকে একটি ডাইতে (ছাঁচ) চাপের মাধ্যমে একত্রিত করে শক্ত আকার দেয়া যায়। ধাতু দিয়ে তৈরি এই যন্ত্রটিতে দুটি সিলিন্ডার আকৃতির পাঞ্চ থাকে। এটিকে বলা হয় আপার বা উপরের পাঞ্চ এবং অন্যটিকে লোয়ার বা নিচের পাঞ্চ। লোয়ার পাঞ্চটি ডাইয়ের সাথে নির্দিষ্ট গভীরতায় এবং আপার পাঞ্চটি যন্ত্রের উপরের অংশে ডাইয়ের মুখোমুখি সংশ্লিষ্ট থাকে, যা কি-না হাতুড়ির মতো কাজ করে। আপার পাঞ্চটি ডাইয়ের উপর জমা পাউডারকে প্রবলভাব্লেচাপ দেয়। সেই চাপের পাউডারগুলো একটি শক্ত আকার ধারণ করে, যা নামই হলো ‘ট্যাবলেট’।

প্রথম পর্যায়ে এই যন্ত্রটি শুধুমাত্র পটাশিয়াম বাই কার্বনেটকে একটি শক্ত আকার দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হতো। পরে এই যন্ত্রটি বিভিন্ন ঔষধ শিল্প প্রতিষ্ঠানের লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ‘ওয়েলকাম’ নামক একটি ব্রিটিশ ঔষধ ফেক্টরি পাউডারকে এমন শক্ত রূপ দেয়ার নামকরণ করেন ট্যাবলেট।

ট্যাবলেটের প্রকার
যুগের পবির্তনের সাথে সাথে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের ট্যাবলেটের আর্বিভাব ঘটে ট্যাবলেট প্রধানত দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি হলো আনকোটেড ট্যাবলেট এবং অপরটি কোটেড ট্যাবলেট। আরো কিছু বিশেষ ফরম হলো এফারডোসেন্ট ট্যাবলেট (পানিতে বুদবুদ তৈরি করে), সলিউবল ট্যাবলেট (পানিতে মিশ্রিত হয়)। ডিসপার্সিবল ট্যাবলেট (পানিতে ট্যাবলেট কণাগুলো ছড়ানো থাকে অর্থাৎ দ্রবীভূত হয়ে যায় না)। এই ধরনের ট্যাবলেটগুলোকে খাওয়ার আগে পানিতে গুলিয়ে নিতে হয়। আরো কিছু বিশেষ ফরম হলো গেস্ট্রো রেজিসটেন্ট ট্যাবলেট (পাকস্থলীর গেস্ট্রিক জ্যুস-এ দ্রবীভূত হব্লেনা এমন), টাইম রিলিজ ট্যাবলেট (নির্দিষ্ট সময় পরপর ড্রাগ ট্যাবলেট থেকে রিলিজ হবে), মুখেই এবজর্ব হব্লেএমন ট্যাবলেট।

ট্যাবলেটের প্রস্তুত প্রণালী
ট্যাবলেট প্রস্তুতি এবং ডিজাইন এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে প্রস্তুতকারক নিশ্চিত করেন যে, সঠিক পরিমাণ ড্রাগটি সঠিকভাবে, সঠিক সময়ে, সঠিক হারে, কাক্সিক্ষত স্থানে পৌঁছাবে। ট্যাবলেটের স্ট্যান্ডার্ড সাইজ হলো ১/৪ ইঞ্চি (গোলাকার বা এর কাছাকাছি অন্যকোনো ধরন)। এরচেয়ে ছোট ট্যাবলেট হ্যান্ডলিং করাটা কিছুটা অসুবিধাকর। ট্যাবলেটের ডোজ (ড্রাগের পরিমাণ) বাড়ার সাথে এর আকারও বাড়তে থাকে। ট্যাবলেট তৈরির ড্রাগ এবং এক্সিপিয়েন্ট দু’টিই পাউডার ফরমড থাকে। যেহেতু ড্রাগ পরিমাণে খুব কম লাগে সেহেতু শুধুমাত্র ড্রাগ দিয়ে একটি ট্যাবলেটের ফর্মে দাঁড় করানো সম্ভব না, আবার ড্রাগ সরাসরি খাওয়াটাও ঠিক না। আর এ কারণেই ট্যাবলেটে ড্রাগের সাথে এক্সিপিয়েন্টের সম্ভন্বয়। এই এক্সিপিয়েন্টগুলো শরীরের জন্য ক্ষতিকারক নয় বরং ট্যাবলেট তৈরিতে এবং শরীরের ভেতরে প্রবেশের পর সঠিকভাবে কার্যসিদ্ধিতে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এবার আসা যাক মূল প্রণালীতে। ট্যাবলেট তৈরির সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো ‘গ্রানুলেশন’ বা দানাদারকরণ। পাউডারগুলোকে ছোট ছোট দানার আঁকার দেয়াকেই বলে গ্রানুলেশন। এই ধাপটি সঠিকভাব্লেসম্পন্ন হলেই ট্যাবলেট তৈরিতে আর কোনো ঝুঁকি থাকে না। আসলে ট্যাবলেট তৈরির পদ্ধতি অনেকটা শীতের ভাপা পিঠা তৈরির মতোই। এর বিভিন্ন ধাপগুলো সম্পর্কে জানার আগে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আমাদেরকে জানতে হবে। তা হলো যে ড্রাগটিকে আমরা ট্যাবলেট আকার দিব তা ‘ওয়াটার সেনসিটিভ’ বা পানির সংস্পর্শে নষ্ট হয়ে যায় কি-না। কারণ এর উপর ভিত্তি করেই গ্রানুলেশন পদ্ধতিকে আবারও দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি হলো ‘ওয়েট গ্রানুলেশন’ (পানির উপস্থিতিতে দানাদার তৈরি) এবং অপরটি হলো ‘ড্রাই গ্রানুলেশন’ (পানির অনুপস্থিতিতে দানাদার তৈরি)। বাকি সব ধাপগুলো একই রকম। আবার বিশেষ কিছু ড্রাগ আছে যা ওয়েট গ্রানুলেশনের পর ভালোভাব্লেসংকোচিত হতে চায় না। এদের ক্ষেত্রেও ড্রাই গ্রানুলেশন করা হয়। এবার ট্যাবলেট তৈরির ধাপগুলো একে একে খুব সংক্ষেপে দেয়া হলো—

ব্লেন্ডিং
এই ধাপটিতে ড্রাগ এবং কিছু কিছু এক্সিপিয়েন্টকে ব্লেন্ডারের মাধ্যমে ব্লেন্ড করা হয়। যাতে করে ড্রাগটি পুরো ট্যাবলেট সমপরিমাণে বিস্তৃত হয়।

ওয়েটিং
এই ধাপে পানি এবং আরো কিছু এক্সিপিয়েন্ট যা পাউডারগুলোকে পরস্পরের নিকট আবদ্ধ হতে সাহায্য করব্লেতা দেয়া হয়। তব্লেড্রাগই গ্রানুলেশনের ক্ষেত্রে পানি জাতীয় বস্তু এই ধাপে ব্যবহৃত হয় না।

গ্রানুলেশন
এটিই হলো সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এই ধাপে গ্রানুলেটর নামক একটি যন্ত্রের সাহায্যে পাউডারগুলোকে দানারমতো আকার দেয়া হয়। 

ড্রাইং
এই ধাপে দানাগুলোকে ড্রায়ারের মাধ্যমে ড্রাই করা হয়। তব্লেলক্ষ্য রাখা হয় যে, দানাগুলো যাতে পুরোপুরি শুকিয়ে না যায়। কারণ এমন হলে চূড়ান্ত পর্যায়ে খুব সহজেই ট্যাবলেট ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার যদি এর উল্টোটি ঘটে অর্থাৎ পরিমাণের তুলনায় কম শুকায় তব্লেট্যাবলেট কিছুটা আঠা আঠা হয়ে যাওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে ডাই থেকে বের করে আনাটা খুব অসুবিধাকর হয়ে উঠে।

সাইজিং
এই ধাপে দানাগুলো একটি বিশেষ ধরনের চালনির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করা হয়। ফলে নির্দিষ্ট আকারের দানা বেরিয়ে আসে। সাধারণত দানাগুলোর সাইজ ৩৫০-৪০০ মাইক্রনমিটারের মতো হয়ে থাকে।

ব্লেন্ডিং
এই ধাপে দানাগুলোর সাথে আরো কিছু এক্সিপিয়েন্ট দিয়ে ব্লেন্ড করা হয়। এই এক্সিপিয়েন্টগুলো ট্যাবলেটকে অক্ষত অবস্থায় ডাই থেকে বের করে আনতে সহায়তা করে।

কমপ্রেশন
এটি ট্যাবলেট তৈরির সর্বশেষ ধাপ। এই ধাপে প্রেস যন্ত্রের সাহায্যে প্রবল চাপের মাধ্যমে দানাগুলোকে ট্যাবলেটের আকার দেয়া হয়। তারপর প্যাক করা হয়।

ঔষধ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো মানসম্মত প্রোডাক্ট তৈরির জন্য ফার্মাসিস্টদের সহায়তায় ট্যাবলেট তৈরির বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এর গুনগত মান নিশ্চিত করে।

ট্যাবলেটের কার্যপ্রণালী
এবার আসা যাক ট্যাবলেটটি শরীরে গিয়ে কিভাব্লেকাজ করে। খাওয়ার পর ট্যাবলেটের বাহ্যিক অংশের খুব সামান্য কিছু কণা পাকস্থলীতে পৌঁছানোর আগে অন্যনালীতে এবজর্ব হয়। তারপর ট্যাবলেটটি যখন পাকস্থলীতে গিয়ে পৌঁছে তখন পাকস্থলীর বিভিন্ন এনজাইম নিঃসরণের ফলে এটা ফুলে ফেটে টুকরো টুকরো হয়। আসলে ট্যাবলেটটি পাকস্থলীর জ্যুস শুষে নেয়ার ফলেই এমনটি ঘটে। এই পর্যায়টিকে বলে ডিজ ইন্টিগ্রেশন। তারপর এই টুকরোগুলো পাকস্থলীর তরল পদার্থগুলোর সাথে দ্রবীভূত হতে শুরু করে। এই পর্যায়টিকে বলে ডিজলিউশন। যখন দ্রবীভূত হয়ে যায় তখন দ্রবণটি আস্তে আস্তে পাকস্থলীর সেমি পারমিত্রবল মেমব্রেনের মাধ্যমে রক্ত প্রবাহিকায় গিয়ে পৌঁছে। তারপর রক্তের চলাচলের সাহায়্যে তা কাক্সিক্ষত স্থানে অর্থাৎ শরীরের যে স্থানে অসুস্থতার ফলে ট্যাবলেটটিকে গ্রহণ করা হয়েছে সেখানে গিয়ে পৌঁছায় এবং এর কার্যকারীতা সম্পন্ন করে। মজার ব্যাপার হলো ড্রাগটি নিজেই তার কার্যকরী স্থান চিনে নেয়।

ট্যাবলেট ব্যবহারে কেন সতর্কতা অবলম্বন করবেন ?
প্রতিটি ট্যাবলেটেরই কিছু না কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। তব্লেরোগীর অসাবধানতার ফলে অর্থাৎ রোগী যদি চিকিৎসকের বিনা পরামর্শে তা গ্রহণ করে, তা হলে এটা অনেক বেশি ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে পারে। এমনকি এই ক্ষতিটি শরীরে স্থায়ীও হয়ে যেতে পারে। যেমন চুল পড়ে যাওয়া, গলা ও মুখের চামড়ায় বাড়তি কিছু কোষ হওয়া এবং তা ঝুলে থাকা ইত্যাদি। অনেক সময় জীবন হানীরও আশঙ্কা থাকে। ট্যাবলেটের প্রস্তুত প্রণালীতে হেরফের হওয়ার ফলেও অনেক সময় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। ফলে দেখা যায় যে অসুবিধা দূর করার জন্য আমাদের এই বস্তুটিকে গ্রহণ করা তা না হয়ে বরং আরো কিছু বাড়তি অসুবিধা শরীরে জুড়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের উচিত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ট্যাবলেট সেবন করা এবং এটা সেবনের বিধি নিষেধগুলো সঠিকভাব্লেমেনে চলা। বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, কিছুটা সুস্থ অনুভব করলেই তারা ঔষধ খাওয়ার ব্যাপারে গড়িমশি শুরু করেন। মনে করেন আর বুঝি ঔষধ না খেলেও চলবে। কিন্তু এটা মোটেও ঠিক নয়। যে রোগটির সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে পরিপূর্ণভাব্লেমুক্তি পাওয়ার জন্য প্রতিটি রোগীরই উচিত নির্দিষ্ট ঔষধের কোর্স সম্পূর্ণ করা এবং কোর্সটি সম্পূরণে অবহেলা না করা। তবেই দীর্ঘসময়ের জন্য সেই রোগটি হতে সুস্থ থাকা সম্ভব।

Exit mobile version