প্রধান খবর
প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৪ শিশুর রক্তে উদ্বেগজনক সীসা
বাংলাদেশের প্রতি ১০ শিশুর মধ্যে ৪ জনের রক্তে উদ্বেগজনক সীসা পাওয়া গেছে। এছাড়া ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের ৩৮ শতাংশ এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীদের প্রায় ৮ শতাংশের দেহে সীসার মাত্রা নিরাপদ মাত্রার চেয়ে বেশি। এর মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ৬৫ শতাংশের বেশি এলাকা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং ইউনিসেফের যৌথ জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। রোববার (১৬ নভেম্বর) রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সেমিনারে মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে-২০২৫ শীর্ষক জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, সীসা দূষণ শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে হুমকি সৃষ্টি করে। এছাড়া এর প্রভাবে আর্থ সামাজিক শ্রেণির উপর পড়ছে। আক্রান্ত শিশুদের অর্ধেকের বেশি ধনী পরিবারের এবং ৩০ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিশু।
বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে সেমিনারে অতিথি ছিলেন, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার। অতিথি ছিলেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষা ও শেখার দক্ষতায় উপস্থিতি ভালো। কিন্তু মৌলিক দক্ষতা দুর্বল। প্রাথমিক স্তরে উপস্থিতি ৮৪ শতাংশ এবং নিম্ন মাধ্যমিকে প্রায় ৬০ শতাংশ হলেও উচ্চ মাধ্যমিকে তা প্রায় ৫০ শতাংশেই আটকে অছে। ৭-১৬ পরিবারের শিশুদের শেখার ফলাফল আরও দুর্বল।
খাবার পানি, পয়ঃব্যবস্থাপনা ও পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে উচ্চ কাভারেজ। কিন্তু পানির গুণমান ঝুঁকিপূর্ণ। উন্নত পানির উৎস ব্যবহারের হার প্রায় ৯৯ শতাংশ এবং উন্নত স্যানিটেশন কাভারেজ ৯২ শতাংশ। কিন্তু পরিবারের ৮০ শতাংশের বেশি পানিতেই কোলাই (কলেরার) জীবাণু পাওয়া গেছে।, যা পানিবাহিত রোগের গুরুতর ঝুঁকি নির্দেশ করে। উৎস পর্যায়ে পানিদূষণ প্রায় ৪৭ শতাংশ। প্রায় ৬৯ শতাংশ পরিবারের হাতধোয়ার সুবিধা থাকলেও তা পূর্বের তুলনায় কমেছে। নিরাপদ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিশেষত পল্লি এলাকায় এখনও দুর্বল।
প্রতিবেদনে শিশু সুরক্ষার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, অগ্রগতি সত্ত্বেও সহিংসতা ব্যাপক। ২০-২৪ বছর বয়সি নারীদের প্রায় ৪৭ শতাংশ ১৮ বছরের আগে বিবাহিত হয়েছে। ১৫-১৯ বছরের কিশোরী বিবাহের হার বেড়েছে। ঘরে শিশুদের প্রতি সহিংস শাসন এখনও ৮৬ শতাংশ শিশুকে প্রভাবিত করছে।
পরিবেশগত স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ভারী ধাতুর ঝুঁকি আছে। প্রথমবারের মতো ভারী ধাতুর উপস্থিতি নির্ণয়ে দেখা যায়, ১২-৫৯ মাস বয়সি এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিশুর রক্তে সীসার উচ্চমাত্রা রয়েছে। শিল্পকারখানা, অনিয়ন্ত্রিত রিসাইক্লিং এবং বিপজ্জনক পণ্য ব্যবহারের মতো কারণ দ্রুত চিহ্নিত করে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
সেমিনারে প্রতিবেদনের মূল ফলাফল উপস্থাপনার পর বিবিএস-এর উপপরিচালক মো. আলমগীর হোসেনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত উন্মুক্ত আলোচনা। এতে সরকারি মন্ত্রণালয়, একাডেমিয়া, উন্নয়ন সংস্থা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তারা পুষ্টি, প্রারম্ভিক শৈশব বিকাশ, পানির নিরাপত্তা ও ভারী ধাতুর ঝুঁকি মোকাবেলায় জরুরি আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
পরবর্তীতে উচ্চপর্যায়ের প্যানেল আলোচনা পরিচালনা করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন সেন্টারের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।প্যানেল সদস্য হিসেবে আলোচনা করেন বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ ও ভুটানের ডিভিশন ডাইরেক্টর, জাঁ পেসমে, ওয়াটারএইডের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের পরিচালক ড. মো. খায়রুল ইসলাম; স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সাবেক সচিব ডা. মো. সরওয়ার বারী, আইসিডিডিআর’বির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো মাহীন সুলতান। প্যানেল সদস্যরা শিশু অপুষ্টি বৃদ্ধি, পানির নিরাপত্তাহীনতা এবং সীসা দূষণকে জাতীয় উন্নয়নের জন্য ‘রেড ফ্ল্যাগ’ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং তাৎক্ষণিক ও সমন্বিত নীতি হস্তক্ষেপের উপর জোর দেন।
সেমিনারের দ্বিতীয় ভাগে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, লিঙ্গ ও নিরাপদ পরিবেশ, ওয়াশ এবং ভারী ধাতু ও অ্যানিমিয়া বিষয়ে চারটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১২ লাখ শিশু শিশু শ্রমে যুক্ত রয়েছে। ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে শিশু শ্রমের হার বেড়েছে। এ হার ২০১৯ সালে ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ, এখন সেটি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ২ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশু সুরক্ষায় প্রতি ১ ডলার বিনিয়োগ করলে নয় গুন সামাজিক ও অর্থনৈতিক লাভ পাওয়া যায়।