প্রধান খবর

দেশের টি-ব্যাগে বিপজ্জনক ভারী ধাতু, ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির শঙ্কা

Published

on

বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি হওয়া অধিকাংশ টি-ব্যাগে বিপজ্জনক ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এনভায়রনমেন্ট ও সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন- এসডো এর একটি গবেষণা প্রতিবেদন ব্রিউইং টক্সিনস: এক্সপোসিং দ্য হেভি মেটাল হ্যাজার্ড ইন টি-ব্যাগস অ্যান্ড ড্রাইড লুজ টি” এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনের ফলাফল অনুযায়ী বাংলাদেশে টি-ব্যাগে থাকা বিপজ্জনক ভারী ধাতুর মাত্রা নিরাপদ মাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত। দেশের অধিকাংশ মানুষের দিনে একাধিকবার চা পানের অভ্যাসের কারনে এটি ভয়ানক স্বাস্থ্যঝুঁকির ইঙ্গিত দেয়। এসডোর প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের সাথে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।

এসডোর এই গবেষণায়, স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করা ১৩ টি নমুনা (১২টি টি-ব্যাগ এবং একটি চা পাতা) পরীক্ষায় দেখা গেছে যে টি-ব্যাগের প্যাকেজিংয়ে বিপজ্জনক মাত্রায় ভারী ধাতু রয়েছে। পরীক্ষায় টি-ব্যাগের প্যাকেজিংয়ে ক্রোমিয়াম সর্বোচ্চ ১,৬৯০ পিপিএম (নিরাপদ সীমা ৫ পিপিএম), সীসা ৫১ পিপিএম পর্যন্ত (সীমা ৫ পিপিএম), পারদ ১০৮ পিপিএম পর্যন্ত (সীমা ০.৩ পিপিএম), এবং আর্সেনিক ১৪ পিপিএম (সীমা ২ পিপিএম) পাওয়া গেছে। টি-ব্যাগে এধরনের ভারী ধাতুর উপস্থিতি নিয়মিত চা পানকারীদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে।

প্রেস ব্রিফিংয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এসডোর চেয়ারম্যান সৈয়দ মার্গুব মোরশেদ বলেন “এটি ভোক্তা অধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন। আমরা অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানাই।”

গবেষণায় টি-ব্যাগ থেকে চা পাতা আলাদা করার পর ভারী ধাতু অ্যান্টিমনি (সর্বোচ্চ ১৫৪ পিপিএম) পাওয়া গেছে। পাশাপাশি নগণ্য পরিমাণে ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম শনাক্ত হয়েছে। ইতিবাচকভাবে, চা পাতার পরীক্ষায় আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, জিঙ্ক এবং কোবাল্টের মতো প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানও পাওয়া গেছে, যা সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ।

Advertisement

এই প্রতিবেদনে বৈজ্ঞানিক গবেষণার পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে ৩,৫৭১ জনের মতামত সংগ্রহ করা হয়, যা দেশের সাধারণ মানুষের চা পানের অভ্যাস ও চা কেনার সচেতনতা তুলে ধরে। জরিপে দেখা যায়, ৫৫% মানুষ প্রতিদিন ২–৩ কাপ এবং ২৭% মানুষ প্রতিদিন ৪ বা তারও বেশি কাপ চা পান করেন। কিন্তু মোট উত্তরদাতাদের মধ্যে মাত্র ১% মানুষ ধারণা রাখেন যে টি-ব্যাগে ভারী ধাতু থাকতে পারে।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের গবেষণা কর্মকর্তা মো. নাজমুল আলম বলেন, “এই গবেষণাটি আমাদের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আমরা আগে জানতাম না যে টি-ব্যাগের প্যাকেজিং এতো ঝুঁকি বহন করে। এই গবেষণা করার সময় সরকারি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদাররা সমন্বয় করলে ভালো হতো। ভবিষ্যতে উভয় পক্ষের অংশগ্রহণমূলক গবেষণা করা জরুরি।”

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই)-এর সহকারী পরিচালক ইসমাত জাহান বলেন, “আমরা এমন যুগান্তকারী গবেষণাকে স্বাগত জানাই। আমরা দ্রুততম সময়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করব। তবে আমাদের অবশ্যই দেশীয় চা শিল্পকে টিকিয়ে রাখা ও বিকশিত করার চেষ্টা করতে হবে।”

বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোঃ মারূফ মোহায়মেন বলেন, “এটি আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক গবেষণা। এটি আমাদের আরও গবেষণা করার দরজা খুলে দিয়েছে।”

বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শোয়েব বলেন, “আমাদের আরও গবেষণার ক্ষেত্রে আরও সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে।”

Advertisement

এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা বলেন— “যদি আমরা চায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারি, তবে এটি মানুষের জন্য শারীরিক ঝুঁকি তো বটেই, মানসিক চাপও তৈরি করবে। আমরা সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

এসডোর সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ড. শাহরিয়ার হোসেন, বলেন— “এ গবেষণা আমাদের খাদ্য শৃঙ্খলে বিষাক্ত ভারী ধাতু প্রবেশ করার পথ রোধ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা। আমাদের উদ্দেশ্য দোষারোপ নয়, বরং নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে যৌথভাবে সংকট মোকাবিলা করা।”

এই গবেষণায় দুটি ধাপ অনুসরণ করা হয়েছে: জনগণের সচেতনতা বোঝার জন্য ভোক্তা জরিপ এবং এক্স-রে ফ্লুরোসেন্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরীক্ষাগারে ধাতুর মাত্রা নির্ধারণ।

এই যুগান্তকারী গবেষণা কেবল জনস্বাস্থ্য সতর্কবার্তাই নয়, বরং ভোক্তার অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জরুরি আহ্বান।

Advertisement

Trending

Exit mobile version