দেশের গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক থাকা না থাকার বিতর্কটি দীর্ঘদিনের। নতুন একটি গবেষণা বলছে, গ্রামাঞ্চলে দায়িত্ব পালনের সময় ৯৬ শতাংশ চিকিৎসক নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। একই গবেষণায় এ–ও দেখা গেছে, সামাজিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ আছে—এমন চিকিৎসকেরা কর্মক্ষেত্রে বেশি অনুপস্থিত থাকেন।
গবেষণাটি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস, যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন ও লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন, অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস, বাংলাদেশের ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকার ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ৯ গবেষক। তাঁদের গবেষণা প্রবন্ধটি ৪ এপ্রিল প্লস গ্লোবাল পাবলিক হেলথ জার্নালের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে। ১৪ পৃষ্ঠার প্রবন্ধের শিরোনাম, ‘অনুপস্থিত কে এবং কেন? বাংলাদেশে চিকিৎসক অনুপস্থিতিতে প্রভাব বিস্তারকারী কারণসমূহ’।
গবেষণার জন্য ঢাকার চারটি তৃতীয় স্তরের (উপজেলা ও জেলা বা সদর হাসপাতালের ওপরের স্তরের হাসপাতাল) সরকারি হাসপাতালে ২০১৯ সালে জরিপ করা হয়েছিল। জরিপে ৩০৮ চিকিৎসকের তথ্য ও মতামত নেওয়া হয়। জরিপের সময় ওই চিকিৎসকেরা ঢাকার হাসপাতালে কাজ করলেও তাদের পদায়ন বা পোস্টিং কোনো না কোনো সময় বাংলাদেশের কোনো গ্রামাঞ্চলে ছিল।
প্রবন্ধে দেখা গেছে, গবেষণার অন্তর্ভুক্ত চিকিৎসকদের ৫৮ শতাংশের বয়স ৩১ থেকে ৩৫ বছর। তাঁদের ৫৪ শতাংশ পুরুষ, নারী ৪৬ শতাংশ। তাঁদের মধে৵ ৯২ শতাংশ বিবাহিত। চিকিৎসকদের ৩১ শতাংশ এমবিবিএস ডিগ্রিধারী। বাকি চিকিৎসকেরা হয় স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী অথবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য তালিকাভুক্ত। জরিপের সময় তাঁদের ৪৭ শতাংশ হাসপাতালে চিকিৎসা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
গবেষণায় যুক্ত ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের গবেষক সৈয়দ মাসুদ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে সব চিকিৎসককে গড়পড়তা দোষারোপ করা হয়। এটা ঠিক না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা দেখতে পেয়েছি, যাঁদের সামাজিক–রাজনৈতিক যোগাযোগ ভালো, অথবা যাঁরা পয়সা খরচ করতে পারেন, তাঁরা গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে আসতে পারেন। যাঁরা গ্রামে থেকে কাজ করেন, তাঁদের কাজের চাপ বেশি হয়। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসা ভালো হয় না। মানুষ তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন। মানুষ এসব চিকিৎসককেই কর্মক্ষেত্রে দেখেন।’
কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে সব চিকিৎসককে গড়পড়তা দোষারোপ করা হয়। এটা ঠিক না।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের গবেষক সৈয়দ মাসুদ আহমেদ
চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা
চাকরি পাওয়ার পর পদায়ন করা এলাকায় দুই বছর কাজ করা চিকিৎসকদের জন্য বাধ্যতামূলক। কিন্তু ২৬ শতাংশ চিকিৎসক বলেছেন, তারা তা করেননি। কাজ না করার প্রধান কারণ প্রশিক্ষণ নেওয়া। ৬৫ শতাংশ চিকিৎসক প্রশিক্ষণ নেওয়ার কারণে নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্রামে কাজ করেননি। ৪১ শতাংশ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন পারিবারিক কাজের কারণে।
জরিপে দেখা গেছে, প্রায় সবাই বলছেন, তাঁরা গ্রামাঞ্চলে কাজের সময়ে নানা সমস্যা বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। ৯৬ শতাংশ বা ২৯৭ জন এমন কথা বলেছেন। কোনো সমস্যার কথা বলেননি ১১ জন।
সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ নানা ধরনের। ৭৩ শতাংশ বলেছেন, গ্রামে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীন পরিবেশ, ৭০ শতাংশ বলেছেন গালমন্দ শুনতে হয়। আর ৫০ শতাংশ বলেছেন, অন্য স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি থাকে। এসব সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য ৪০ শতাংশ চিকিৎসক পরিবারের সাহায্য চান, ৩৯ শতাংশ স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সহায়তা চান এবং ৩৫ শতাংশ প্রতিবেশী বা সহকর্মীদের সাহায্য চান। অর্থাৎ অনেকেই একাধিক বিকল্পের খোঁজ করেন।
জরিপে দেখা গেছে, ৬৩ শতাংশ চিকিৎসক গ্রামাঞ্চলে তাঁদের জন্য বরাদ্দ করা বাসায় থাকেন না। ৭৬ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, পরিবার তাঁদের সঙ্গে বরাদ্দ করা বাসায় থাকেন না। বাসা ব্যবহার না করার কারণও চিকিৎসকেরা উল্লেখ করেছেন। প্রথম কারণ নিরাপত্তাহীনতা বলেছেন ৭৭ শতাংশ উত্তরদাতা। ৭২ শতাংশ চিকিৎসক বলেছেন বাসস্থানের মৌলিক সুযোগ–সুবিধার ঘাটতির কথা। আবার ৪০ শতাংশ বলেছেন, যাতায়াতের সুব্যবস্থা নেই।
ঘাটতি থাকে চিকিৎসায়
গ্রামীণ অঞ্চলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকের ঘাটতি থাকেই। তারপরও কিছু চিকিৎসক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে থাকেন এবং চিকিৎসা অব্যাহত রাখেন। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলতে পারেন এমন চিকিৎসকেরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে থেকে কাজ করেন। গবেষকেরা বলেন, চিকিৎসক অনুপস্থিতির সমস্যাটি সর্বজনীন না এবং চিকিৎসকের সামাজিক–রাজনৈতিক যোগাযোগের ওপর তা অনেকাংশে নির্ভর করে। যাঁদের সেগুলো নেই বা দুর্বল, তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর সামন্ত লাল সেন গ্রামাঞ্চলের চিকিৎসাসেবা দৃঢ় ও উন্নত করার কথা বলছেন। গ্রামাঞ্চলে কীভাবে চিকিৎসক ধরে রাখা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ চেয়েছেন। গবেষকেরা বলছেন, ভীতি উদ্রেককারী বা অসহায়তামূলক আচরণ দূর করার ব্যাপারে নীতি উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। যেসব চিকিৎসক কাজে লেগে থাকেন, তাঁদের ব্যাপারে বিশেষ ইতিবাচক ব্যবস্থা থাকা চাই।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ইকবাল আর্সনাল বলেন, গবেষণাটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যেভাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে চিত্রায়িত করে, বাস্তবতা তা থেকে ভিন্ন। চিকিৎসকেরা অনেক সমস্যার মধে৵ থেকে কাজ করেন, সেবা নিয়েও মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আছে। অন্য পেশাজীবীর তুলনায় পদোন্নতিতে পিছিয়ে আছেন চিকিৎসকেরা, তা নিয়ে ক্ষোভ আছে চিকিৎসকদের মধ্যেও। নীতিনির্ধারকদের ঠিক বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে, যার কিছু ইঙ্গিত এই গবেষণার মাধ্যমে পাওয়া গেছে।