Site icon স্বাস্থ্য ডটটিভি

প্রথম জিনগত রূপান্তরিত শুকরের কিডনি মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন

বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিনগত রূপান্তরিত একটি শূকরের কিডনি মানুষের শরীরে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের সার্জনরা কিডনি প্রতিস্থাপন অপারেশন করেছে। এটি বিশ্বের প্রতিস্থাপন চিকিৎসায় এক যুগান্তকারী মাইলফলক।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের সার্জনরা এই বিরল চিকিৎসা কৃতিত্ব দেখান। চিকিৎসকরা মরনঘাতী টার্মিনাল কিডনি রোগে আক্রান্ত ৬২ বছর বয়সী রোগী রিচার্ড স্লেম্যানের শরীরে জিনগত রূপান্তরিত শূকরের কিডনি সফলভাবে প্রতিস্থাপন করেছেন। স্লেম্যানের বাঁচানোর শেষ আশা হিসেবে তাঁরা এই পদক্ষেপ নিয়েছেন। তার নেফ্রোলজিস্ট উইনফ্রেড উইলিয়ামস জানিয়েছেন, শূকরের কিডনি মানবদেহে প্রতিস্থাপন সত্যিই একটি যুগান্তকারী মাইলফলক।

উইলিয়ামস বলেন, স্লেম্যানকে একটি নতুন কিডনির জন্য অপেক্ষার তালিকায় থাকতে হতো। তাকে ছয় থেকে সাত বছর অপেক্ষা করতে হতো। ততদিন স্লেম্যান বেঁচে থাকতেন কিনা সন্দেহ। তাই ম্যাসাচুসেটস জেনারেলের কিডনি প্রতিস্থাপনের মেডিক্যাল ডিরেক্টর ডা. লিওনার্দো রিয়েলা আরেকটি বিকল্প প্রস্তাব করেন: শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপন। উইলিয়ামস বলেন, স্লেম্যান এতে সম্মত হন। কারণ তিনি ডায়ালাইসিস নিয়ে ক্রমেই হতাশ হয়ে পড়ছিলেন। তার বেঁচে থাকার অন্য কোনো উপায় নেই এমনটা লিখিত নিয়েই চিকিৎসকদের এই চিকিৎসা করার ইমার্জেন্সী অনুমোদন দেয় যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ। চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহনের সম্মতি দেওয়ার আগে রোগীকে পদ্ধতির ঝুঁকি সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবহিত করা হয়েছিল এবং পদ্ধতিটির অজানা ঝুঁকি এবং সুবিধাগুলির ছিল পরীক্ষামূলক। স্লেম্যান বলেন, আমি বাঁচতে চাই। তাই, এই শেষ সুযোগ (শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপন) ছিল অনেকটা অন্ধকারে গুলি ছোড়ার মতো, কিন্তু এটিই ছিল আমার শেষ পছন্দ।

চিকিৎসকদের দল জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন নামক পদ্ধতিটি পরিচালনা করার জন্য কেমব্রিজ-ম্যাসাচুসেটস ভিত্তিক ঔষধ প্রস্তুতকারক ইজেনেসিস থেকে শুকরের জিনগত রূপান্তরিত কিডনি সংগ্রহন করেন। শরীরের প্রত্যাখ্যান ও সংক্রামণ ঝুঁকি কমানোর জন্য কিডনিতে মোট ৬৯টি জিনগত রূপান্তর করা হয়। নেফ্রোলজিস্ট উইনফ্রেড উইলিয়ামস বলেন, কিডনি যদি ভালোভাবে কাজ করতে থাকে তাহলে আমি মনে করি এটি চিকিৎসা জগতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটি অগ্রগতির প্রতিনিধিত্ব করে। মানুষের দেহে প্রথম সফলভাবে শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপন বা তথাকথিত জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন একটি মাইলফলক।

জিনগত রূপান্তরিত শূকরের এই কিডনি ভালোভাবে কাজ করলে এই গবেষণা সারা বিশ্বের বহু মানুষের প্রাণ বাঁচাবে বলে আশা করছেন অস্ত্রোপচারের সঙ্গে যুক্ত সার্জন ও গবেষকরা। সাধারণত মানুষ থেকে মানুষে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের কাজ হয়ে থাকে। অঙ্গের জন্য অপেক্ষা করে সব সময় মানুষ মারা যাচ্ছে। যদি জিনগত রূপান্তরিত শূকরের অঙ্গ ব্যবহারে সফলতা আসে, তবে এ ধরনের মানুষের আর অপেক্ষা করতে হবে না। যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় থাকা রোগীদের মধ্যে দিনে গড়ে ১৭ জনের মৃত্যু হচ্ছে। সেখানে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের তালিকায় থাকা রোগীদের সংখ্যা লক্ষাধিক। জিনগত রূপান্তরিত শূকরের এই কিডনি প্রতিস্থাপন একটি যুগান্তকারী অস্ত্রোপচার এবং এটি অঙ্গের ঘাটতির সংকট সমাধানের এক মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। বিশ্বের এই প্রথম জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন সার্জারি ভবিষ্যতে রোগীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নতুন বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে কাজ করবে।

হাসপাতালের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এর আগে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে স্লেম্যানের একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু গত বছর তার সেই কিডনিটি বিকল হয়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। পরে ডায়ালাইসিস নেওয়া শুরু করেন তিনি। ডায়ালাইসিসের কারণে শরীরে জটিলতা তৈরি হওয়ায় চিকিৎসকরা তাকে শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন।

স্লেম্যান বলেছেন, ‘‘আমি এটাকে কেবল আমার নিজের জন্য সহায়তার উপায় হিসেবে দেখছি না। বরং এটা হাজার হাজার মানুষকে আশান্বিত করার একটি উপায়; যাদের বেঁচে থাকার জন্য কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট প্রয়োজন।’’

চিকিৎসকদের এই ঘোষণা জেনোট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের যুগান্তকরী এক সফলতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রাণীকূলের শরীরের কোষ, টিস্যু বা অঙ্গ দিয়ে মানুষের রোগ নিরাময়ে যুগের পর যুগ ধরে চিকিৎসকরা যে চেষ্টা চালিয়েছেন, তারই উল্লেখযোগ্য সাফল্য বলে প্রশংসা করেছেন অনেকে।

কয়েক দশক ধরে চিকিৎসকরা চেষ্টা চালালেও মানুষের শরীরে শূকরের কিডনি কাজ করেনি। বরং মানুষের শরীরের ইমিউন সিস্টেম তাৎক্ষণিকভাবে অন্য প্রাণীর টিস্যু ধ্বংস করে ফেলে। সম্প্রতি শূকরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ নিয়ে মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপনের বেশ কিছু প্রচেষ্টা চালিয়েছেন চিকিৎসকরা। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেওয়ার আগে জিনগত পরিবর্তন এনে শূকরের জন্ম দেওয়া হয়; যাতে তাদের অঙ্গগুলো মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো হয়।

এর আগে, ২০২১ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের একদল চিকিৎসক মানবদেহে শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপন করে অনন্য এক সফলতা পান। তবে সেটি করা হয়েছিল ‘‘ক্লিনিক্যালি ডেড’’ ঘোষণা করা এক নারীর শরীরে। একদিন জীবন-রক্ষাকারী কিডনি প্রতিস্থাপনে মানুষের শরীরে প্রাণীর কিডনি সফলতার মুখ দেখবে বলে গত কয়েক দশক ধরে চিকিৎসকরা যে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন; নিউ ইয়র্কের চিকিৎসকরা সেই প্রচেষ্টায় প্রথম সফলতা পান।

ওই সময় চিকিৎসকরা বলেছিলেন, শূকরের একটি জিন পাল্টে দিয়েছিলেন তারা। পরে পরিবর্তিত জিনে নতুন শূকরের জন্ম দিয়ে সেটি বড় করে তোলেন। এরপর সেই শূকরের কিডনি মানবদেহে প্রতিস্থাপন করে দেখতে পান সেটি স্বাভাবিকভাবেই কাজ করছে।

Exit mobile version