স্বাস্থ্য বলতে আমরা সাধারণত শারীরিক স্বাস্থ্যই বুঝি। কিন্তু একজন মানুষ শুধু শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলেই কি তাকে সুস্থ বলা যায়? যায় না। কারণ শরীর ও মনের সমন্বয়ে মানুষ। তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য একই সুতায় গাঁথা। শরীর ও মনের কোনো একটির সুস্থতা ছাড়া অন্যটির সুস্থতা নিশ্চিত করা যায় না। মনের উৎপত্তিস্থল শরীর, আবার শরীর চলে মনের ইশারায়।
সারা বিশ্বের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যার ১৩ শতাংশ মানসিক। মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব অনুধাবন করেই ১৯৯২ সাল থেকে প্রতি বছর ১০ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সচেতনতার এই দিনটি অনেক দেশে মানসিক রোগ সচেতনতা সপ্তাহের অংশ হিসেবেও পালিত হয়। বাংলাদেশেও দিনটি নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হয়। এবারের মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আমাদের মন, আমাদের অধিকার’।
আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি, অবনতি কিংবা ভারসাম্য শুধু শারীরিক সুস্থতার ওপর নির্ভরশীল নয়। আমরা যে সমাজে বাস করি তার সামাজিক স্বাস্থ্য, যে প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করি তার পরিবেশগত স্বাস্থ্য, যে ধর্মীয় বিশ্বাসের ভেতর বাস করি তার আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য, যে রাজনৈতিক ক্ষমতাকাঠামোর ভেতর বাস করি তার রাজনৈতিক স্বাস্থ্য ইত্যাদির ওপর মানসিক স্বাস্থ্য নির্ভরশীল। জীবন ধ্বংসকারী হরেকরকম মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত হলেও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়টিকে আমাদের দেশে নতুনই বলা যায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে প্রথমবারের মতো হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন, তার ৫.৭ শতাংশ মনে করেন মনোরোগ চিকিৎসকরা তাদের পাগল হিসেবেই মূল্যায়ন এবং চিকিৎসা করবেন। অথচ এটি একটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা।
শরীরের ভেতর যেমন সমস্যা হয়, মনের ভেতরও তেমন সমস্যা হতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং চিকিৎসা বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য ও জ্ঞান না থাকার কারণে অনেকে এ ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য পীর, ফকির, ওঝা, কবিরাজ ও হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে যান এবং অবৈজ্ঞানিক উপায়ে চিকিৎসা গ্রহণ করেন; যার দীর্ঘমেয়াদি ফল বেশ খারাপ হতে পারে। জিনগত, বংশগত ত্রুটি, নেতিবাচক পরিবেশে নেতিবাচক অভিজ্ঞতার ভেতর বেড়ে ওঠা, ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষণ প্রক্রিয়া, দুর্বল পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক, দরিদ্রতা, নেতিবাচক প্রতিযোগিতার মানসিক চাপ, লোভ, ঘৃণা, মাত্রাতিরিক্ত আমিত্ববোধ, সর্বোপরি জীবন ও জগৎ সম্পর্কে অবাস্তব ও অসত্য দৃষ্টিভঙ্গির চর্চা ইত্যাদি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরিতে প্রধান প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
জীবনে চলার পথে সবাই কমবেশি মানসিক জটিলতার ভেতর দিয়ে যায়। কেউ কেউ সেসব জটিলতা সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারে, আবার কেউ সেগুলো সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে না পেরে ভেঙে পড়ে। কেউ আবার মোকাবিলা করতে গিয়ে সচেতন কিংবা অসচেতনভাবে এমন কিছু ত্রুটিপূর্ণ চিন্তা ও আচরণ করে, যা বিদ্যমান জটিলতা আরও গভীর সমস্যার দিকে নিয়ে যায়। কিছু কিছু সমস্যা আছে যেগুলো সৃষ্টির পেছনে নেতিবাচক পরিবেশ, ত্রুটিপূর্ণ চিন্তা ও আচরণের ধরন, নেতিবাচক লাইফস্টাইল মূলত বেশি দায়ী থাকে; যেমন প্রাথমিক ডিপ্রেশন, স্ট্রেস ইত্যাদি। আবার অন্যদিকে সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার, অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার, অটিজম ইত্যাদির জন্য জেনেটিক্যাল বা বংশগত কারণ একটু বেশি দায়ী থাকে।