বাংলাদেশে প্রতি আটজনে একজন মানসিক রোগী। প্রাপ্তবয়স্কদের ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং শিশুদের ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ মানসিক সমস্যায় ভুগছে। তবে চিকিৎসাসেবায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় মানসিক সমস্যায় ভোগা ৯১ শতাংশই চিকিৎসা পায় না।
দেশের শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ মানসিক রোগে আক্রান্ত। বয়স্কদের পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের মধ্যেও মানসিক রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার গবেষণা কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শিশু-কিশোরদের মধ্যে একটি বড় অংশ মানসিক রোগে ভুগছে। তাদের মধ্যে অর্ধেকেরই মানসিক অসুস্থতা শুরু হয় ১৪ বছর বয়স বা আরও আগে। এসব অসুস্থতার বেশিরভাগই অগোচরে থেকে যাচ্ছে। এই বিষণ্নতার একপর্যায়ে তরুণ-তরুণীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) জরিপ বলছে, বিশ্বে প্রতি আটজনে একজন মানসিক রোগে আক্রান্ত। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এ হার ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, আর শিশুদের মধ্যে ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ। চিকিৎসাসেবায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় মানসিক সমস্যায় ভোগাদের ৯১ শতাংশই চিকিৎসা পায় না।
এ অবস্থায় আজ ১০ অক্টোবর পালিত হচ্ছে ব্শ্বি মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘মানসিক স্বাস্থ্য একটি সর্বজনীন মানবাধিকার’। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিবসটি উপলক্ষে সোমবার (৯ অক্টোবর) জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট আলোচনা ও শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন দিবসটি উপলক্ষে আলোচনা সভাসহ সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করবে।
মানসিক স্বাস্থ্য বাংলাদেশ তথ্যচিত্র ২০২১ অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানসিক রোগে আক্রান্ত। এ ছাড়া উদ্বেগাধিক্য ৪ দশমিক ৭ শতাংশ, বিষণ্নতা ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, সোমাটিক সিম্পটম ডিজঅর্ডার ২ দশমিক ৩ শতাংশ, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ, বাইপোলার ডিজঅর্ডার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ, সিজোফ্রেনিয়া শূন্য দশমিক ১ শতাংশ।
মানসিক রোগের বিষয়টিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, মানসিক রোগে আক্রান্তরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার। মানসিক স্বাস্থ্য রোগ ও এর চিকিৎসার প্রতি মানুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অনেকাংশে দায়ী। এ রোগে আক্রান্তদের প্রতি সমাজে মর্যাদাবোধের অভাব লক্ষ করা যায়। এজন্য মানসিক রোগের চিকিৎসা নিতে অনেকে লজ্জাবোধ করেন। কিন্তু শারীরিক রোগের চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে এমনটি দেখা যায় না।
মনোবিদ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, আগে দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো না। এখন এর গুরুত্ব কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু তা অপ্রতুল। রোগীর তুলনায় সেবার পরিধি কম। বিশেষ করে হাসপাতালে শয্যা ও চিকিৎসকসংখ্যা বাড়াতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। পাশাপাশি এ সেবার সরকারি বরাদ্দও বাড়াতে হবে। অন্যথায় চিকিৎসার বাইরে থাকা রোগীরা সেবাবঞ্চিত হবে। তাতে করে সমাজ ও রাষ্ট্রে এক ধরনের সংকট তৈরি হবে।
মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য এবং মানসিক রোগÑ এ দুটি বিষয়কে অনেকে এক করে বিবেচনা করেন। মানসিক রোগ বা মানসিক সমস্যা হচ্ছে, মনের কোনো অস্বাভাবিক অবস্থা। এই সমস্যা দূর করতে কখনও ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করতে হয়, আবার কখনও সাইকোথেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করতে হয়। কিন্তু মানসিক রোগ নেইÑ এমন ব্যক্তিরও মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা করা উচিত, যাতে সে মানসিক রোগ বা সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। সার্বিক সুস্থতার জন্য পরিবারের সবার মনের যত্ন নিতে হবে। এজন্য পরিবারের সদস্য বিশেষ করে অভিভাবকদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। পাশাপাশি মনের যত্নের জন্য নিয়ম করে ঘুম ও সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হবে।
চিকিৎসায় সংকট
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, দেশে দুই কোটির মতো মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত হলেও এর বিরপীতে বিশেষজ্ঞ রয়েছেন মাত্র ২৭০ জন। তাদের মধ্যে প্রায় একশর বেশি চিকিৎসক রাজধানীতেই অবস্থান করছেন। জেলা ও উপজেলায় অধিকাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। সরকারি পর্যায়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, পাবনা মানসিক হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য শয্যাসংখ্যা আছে মাত্র ৮১৩টি। এ ছাড়া কয়েকটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সীমিত পরিসরে মানসিক রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বিভাগ, জেলা ও উপজেলাপর্যায়ে পৃথক কোনো সেবাকেন্দ্র নেই। এতে করে মানসিক রোগে আক্রান্তরা চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক অভ্র দাস ভৌমিক বলেন, দেশে যে হারে মানসিক রোগীর চাপ বাড়ছে সে তুলনায় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে না। একই সঙ্গে চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ানসহ এ খাতের জনবলও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এ বিষয়ে সরকারকে নজরদারি বাড়াতে হবে। মানসিক রোগে আক্রান্তদের জন্য পৃথক বরাদ্দের পাশাপাশি প্রত্যেকটি বিভাগে অন্তত একটি মানসিক রোগের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান থাকা প্রয়োজন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, আগের তুলনায় মানসিক রোগ চিকিৎসার পরিধি বেড়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের প্রতিটি হাসপাতালে যাতে মানসিক রোগ বিষয়ে অন্তত একজন করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক থাকেন সেজন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যে তা কার্যকরও করা হয়েছে। অন্যগুলো পর্যায়ক্রমে কার্যকর করা হবে।