‘ভাতের কষ্ট কী তা আমি জানি। আমার আব্বা একজন চায়ের দোকানি ছিলেন। নিজেদের সামান্য জমিও নেই। সেই পরিবারে থেকে চিকিৎসক হওয়াতো দূরের কথা, মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হওয়াই সম্ভব ছিলো না। তবে সকল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আমি এমবিবিএস পাস করেছি। আর এর পুরো কৃতিত্বের ভাগিদার একজন শামসুদ্দিন স্যার।’ এভাবেই দারিদ্রতাকে পেছনে ফেলে নিজের সাফল্যের কথা বলছিলেন রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার মেয়ে মোছা. শিউলি আক্তার।
স্বামীর পাশে বসেই শিউলি শোনাচ্ছিলেন তাঁর জীবনের এ নিষ্ঠুর দারিদ্রতাকে পেছনে ফেলে নিজের সাফল্যের গল্প।
এক কেজি আটার দাম তখন ১০ টাকা, আর একটা খাতার দামও ১০ টাকা। আটা কিনলে খাতা হয় না, আবার খাতা কিনলে না খেয়ে রাত কাটাতে হয়। তারপরও খাতাই কিনেছিলেন শিউলি। ভাতের অভাব থেকে মুক্তির আশায় স্কুলে পড়ার সময় মা–বাবা তাঁকে বিয়ে দিয়েছিলেন। শ্বশুরবাড়িতে ভাতের অভাব ছিল না, কিন্তু সেখানেও তাঁর কান্না থামেনি। বাড়ির বউকে আর পড়াতে চাননি তাঁরা। শিউলির জেদ, তিনি পড়বেন। স্বামীও পড়াবেন। এরপর বাড়িতে শিউলির ভাত বন্ধ হয়ে যায়। না খেয়েই কলেজে যান। প্রতিবাদ করায় স্বামীসহ শিউলিকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। স্বামী সামান্য বেতনে একটি কোম্পানির কাজ করতেন। বাড়ি ভাড়া দিলে আর খাওয়ার কিছু থাকে না। এরই মধ্যে শিউলি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পান। পড়তে পড়তেই মা হয়েছেন। এসব করেই এবার তিনি বারিন্দ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন। সব মিলে শিউলির জীবনটা সিনেমার গল্পের মতো। শেষ দৃশ্যে এসেও চোখের পানি মুছতে হয়। অল্প দিনের জন্য তাঁর বাবা মেয়ের এ সাফল্য দেখে যেতে পারেননি। এ কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন শিউলি।
বারিন্দ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামসুদ্দিনের সঙ্গে শিউলি
পুরো নাম শিউলি আক্তার। স্বামী রাশেদুর রহমান। তাঁরা এখন রাজশাহী নগরের মেহেরচণ্ডী মধ্যপাড়া এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। শিউলির মা সাবিয়া বেগমও মেয়ের সঙ্গেই থাকেন।
শিউলির বাবার বাড়ি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার মুক্তারপুর খলিফাপাড়া গ্রামে। সরদহ ট্রাফিক মোড়ে তাঁর বাবা জাহাঙ্গীর হোসেনের একটি চায়ের দোকান ছিল। এটিই ছিল শিউলিদের পরিবারের আয়ের একমাত্র উত্স। সেই চায়ের দোকানটিও একসময় পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। তাঁর শিক্ষাজীবনের শুরুই হয়েছে যেন অবহেলার মধ্য দিয়ে। পড়ার জন্য এক শিক্ষকের বাসায় গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর মাকে একটি ভাঙা চেয়ারে বসতে দেওয়া হয়েছিল। অন্যদের বসানো হয়েছিল ভালো জায়গায়। তাঁর শিশু মনে এটি তখন দাগ কেটেছিল। তখন থেকেই তাঁর জেদ, যেকোনো মূল্যে পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন। কিন্তু অভাবের সঙ্গে দৈনিক তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। ভাঙা ঘরে বৃষ্টির রাতে ঘুমানো যেত না। না খেয়েও স্কুলে যেতে হয়েছে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির বৃত্তির টাকা দিয়েই পড়ার খরচ চালাতে হয়েছে। এ অভাবের কারণেই নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষার আগের দিন রাতে হঠাৎ তাঁর বিয়ে হয়ে গেল। এসএসসি পাস স্বামী তখন একটি বাল্ব কোম্পানিতে চাকরি করতেন। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্বামীর সেই চাকরিটাও চলে গেল। এসবের মধ্যেই ২০১১ সালে সরদহ সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় সব বিষয়ে শিউলি পেলেন জিপিএ-৫।
রাজশাহী কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পরও যাতায়াত খরচের টাকার কথা ভেবে সেখান ভর্তি হননি। শ্বশুরবাড়ির কাছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজে ভর্তি হলেন। তখন তাঁর স্বামী রাশেদুর রহমান বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষতে (বিএমডিএ) মাসিক দেড় হাজার টাকার একটি কাজ পান। এ সময় শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বাধার মুখে শিউলির পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তাঁরা বাড়ির বউকে পড়াশোনা করতে দিতে চান না। পড়াশোনা বন্ধ করতে তাঁর ভাত বন্ধ করে দেওয়ার মতো নিষ্ঠুর আচরণও করেছে তাঁর পরিবারের লোকজন। স্বামীর পাশে বসেই শিউলি শোনাচ্ছিলেন তাঁর জীবনের এ নিষ্ঠুরতার গল্প। স্বামীও স্বীকার করলেন, স্ত্রীর পক্ষ নেওয়ায় সে সময় তাঁদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়াবাড়িতে ওঠেন রাশেদুর।
২০১৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় শিউলি আবারও সব বিষয়ে এ প্লাস পেলেন। ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল মেডিকেলে পড়বেন। প্রথমবার হলো না। দ্বিতীয়বার অল্প নম্বরের জন্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ হলো। এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর স্থানীয় একটি পত্রিকায় খবর হয়েছিল ‘অর্থের অভাবে কি শিউলি ফুটবে না?’ খবর শুনে অনেকেই ছুটে গেলেন কিন্তু বিবাহিত মেয়ের কথা শুনে পরে কেউ সাড়া দেননি। শিউলি বলেন, এটা তাঁর জীবনের সবচেয়ে হতাশার সময়। তীরে এসে তরি ডুবে যাওয়ার মতো দশা। নিজেরা কিছুই করতে পারছেন না। স্বামীর বেতনটা শুধু দেড় হাজার থেকে বেড়ে ৩ হাজার ৬০০ টাকা হয়েছে। এমন সময় একদিন বারিন্দ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শামসুদ্দিন শিউলির খবর নেওয়ার জন্য গাড়ি পাঠালেন। সব শুনে শামসুদ্দিনই তাঁকে বারিন্দ মেডিকেল কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলেন। শুধু ভর্তি না, শিউলির পড়াশোনার খরচের (প্রায় ৩০ লাখ টাকা) পুরো দায়িত্ব নিলেন তিনি। পড়াশোনার বাইরেও বাসার বাজার, টুকটাক দরকারি জিনিসপত্র নিয়মিত কিনে দিয়েছেন।
একজন শামসুদ্দিনের মহানুভবতায় ‘অর্থের অভাবে ফুটবে না শিউলি!’এখন ডাক্তার
মেডিকেল কলেজে ভর্তির পরই ২০১৫ সালের ৭ জুন ছেলে সন্তানের জন্ম দেন শিউলি। ১৫ দিন পর থেকেই পেটে বেল্ট বেঁধে ক্লাসে যাওয়া শুরু করেন শিউলি। একটাই লক্ষ্য, ডাক্তারি পড়া শেষ করতেই হবে।
শিউলির ভাষায়, ‘অনেক দিন না খেয়ে কলেজে এসেছি, স্যার নাশতা করিয়েছেন। ২০১৬ সালে এমডি স্যার (মো. শামসুদ্দিন) আমার স্বামীকে এই মেডিকেল কলেজে চাকরি দিলেন। কর্মচারীর স্ত্রী বলে ব্যাচের কেউ স্টাডি গ্রুপে নেয়নি। প্রথম বেঞ্চে বসলে সে বেঞ্চে আর কেউ বসতেন না। পেছনে গেলেও একাই বসতে হতো। ক্যানটিনেও একই অবস্থা হতো। এমনও দিন গেছে সহপাঠীদের মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে এমডি স্যারের কাছে গেছি। তিনি আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন। এইটুকু না পেলে আমাকে হয়তো আত্মহত্যা করতে হতো। আমি জেনেছি, এমডি স্যার এভাবে আরও অনেক অসহায় শিক্ষার্থীর জীবন পাল্টে দিয়েছেন। আজীবন তিনি আমার বাবার জায়গায় থাকবেন।’
১ ফেব্রুয়ারি থেকে শিউলির ইন্টার্নশিপ শুরু হবে। ইতিমধ্যে শিউলির স্বামীও বিএ পরীক্ষা দিয়েছেন। শিউলির ইচ্ছা স্বামীর এমএ ডিগ্রি হওয়ার পরে তাঁকে একটা ওষুধের দোকান করে দেবেন। আর পুরোপুরি ডাক্তার হওয়ার পর মানুষের সেবায় নিজেকে সঁপে দেবেন। নিজে যেমন কষ্ট পেয়ে বড় হয়েছেন, সেই রকম কষ্টে থাকা মানুষের জন্য কিছু করতে চান। ভেবেছেন, গরিব ও অসহায় মানুষের সেবা দেবেন বিনা মূল্যে। যেভাবে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন একজন মানুষ।
শামসুদ্দিন শুধু শিউলিকে লেখাপড়া করিয়েছেন তাই নয়, শিউলির স্বামীকে বারিন্দ মেডিকেল কলেজে চাকরি দিয়েছেন। শিউলির সংসারে একটি সন্তান রয়েছে। অভিভাবক হিসেবে এ পর্যন্ত পুরো সংসারের ব্যয়ভারও বহন করে চলেছেন তিনি। শিউলির আর্থিক অনটনে ও নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে সামনে এগিয়ে যেতে সবসময় উৎসাহ ও সাহস দিয়েছেন বারিন্দ মেডিকেলের এমডি ও পিতৃতুল্য মোহাম্মদ শামসুদ্দিন। তার আরেকটি পরিচয় তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও রাজশাহী ৬ আসনের সাংসদ মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলমের পিতা।
উল্লেখ্য, শুধু শিউলি নয়, বাঘা ও চারঘাট উপজেলাসহ রাজশাহীর অন্তত ৩০ জন শিক্ষার্থীকে মোহাম্মদ শামসুদ্দিন নানাভাবে সহযোগীতা করেছেন। যাদের কেউ বর্তমানে পুলিশের সার্জেন্ট, এ্যাকাউন্স অফিসার, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কেউবা পড়ছেন বুয়েটে। এছাড়া দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের বিয়েতে সহযোগীতা, অসহায় ও দুস্থদের অর্থ ও পণ্য দিয়ে নিভৃতেই সহযোগীতা করে চলেছেন তিনি।