‘টিকাদানেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বে রোল মডেল’

স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। এই কর্মসূচির সাফল্যের পাল্লাটা বেশ ভারী, যার জন্য মিলছে নানান স্বীকৃতি।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ কর্মসূচি বাংলাদেশকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করছে। সব থেকে বড় কথা হলো, এ কর্মসূচির ফলেই দেশে মা ও শিশুমৃত্যুর হার কমানোর পাশাপাশি পঙ্গুত্ব রোধ করা সম্ভব হচ্ছে।

রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি তৃণমূলের স্বাস্থ্যকর্মী-মাঠকর্মীদের আন্তরিকতা আর কমিউনিটির জনগণ, বিশেষ করে মায়েদের সক্রিয় অংশগ্রহণেই সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে সাফল্য আনা সম্ভব হয়েছে। টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশের সফলতার জন্য গত ২৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পুরস্কার দিয়েছে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন এবং ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই)।

২০১০ সালে প্রকাশিত গুড হেলথ অ্যাট লো কস্ট: টোয়েন্টি ফাইভ ইয়ারস অন শীর্ষক বইয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে অগ্রগতির যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়, তার মধ্যে ছিল বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচি। বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট ২০১৩ সালে শুধু বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন দিক নিয়ে একটি সিরিজ প্রকাশ করে। সেখানে টিকাদান কর্মসূচিতে কমিউনিটি, অর্থাৎ তৃণমূলের অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রমকে সাফল্যের প্রধান নিয়ামক হিসেবে তুলে ধরে।

ইপিআই বিশ্বব্যাপী কর্মসূচি, যার মূল লক্ষ্য সংক্রামক রোগ থেকে শিশু, মাতৃমৃত্যু ও পঙ্গুত্ব রোধ করা। এ কর্মসূচির উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠী হচ্ছে ০ থেকে ১৮ মাস বয়সী সব শিশু এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী সন্তান ধারণক্ষম সব নারী। যক্ষ্মা, ডিফথেরিয়া, হুপিং কাশি, মা ও নবজাতকের ধনুষ্টঙ্কার, হেপাটাইটিস-বি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি, নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া, পোলিও মাইলাইটিস, হাম ও রুবেলা—এই ১০ রোগের বিরুদ্ধে নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। সরকারের এ কার্যক্রমে সার্বিকভাবে সহায়তা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)। শহর এলাকায় সরকারের কার্যক্রমে স্থানীয় এনজিও সম্পৃক্ত রয়েছে। ইপিআই কর্মসূচির মাধ্যমে সারা দেশে বিনা মূল্যে এ টিকাগুলো দেওয়া হয়।

সরকারের হিসাব বলছে, গত বছর ইপিআই কর্মসূচিতে সব টিকাপ্রাপ্তির হার ৯৭ দশমিক ৬ শতাংশ। হাম ও ডিপিটি ছাড়াও বিসিজি তথা যক্ষ্মার যে টিকা দেওয়া হয়, তার হার ১৯৮৫ সালে ছিল মাত্র ২ শতাংশ, যা পরবর্তী সময়ে বেড়ে দাঁড়ায় ৯৯ শতাংশে। টিকাদান কর্মসূচির কলেবর দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল দেশে ৬টি রোগের বিরুদ্ধে ইপিআই কার্যক্রম শুরু হয়, যা বর্তমানে ১০টি রোগের ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হয়েছে। ১৯৮৫ সাল থেকে গ্রাম ও শহর এলাকায় ইপিআই সেবা পর্যায়ক্রমে সব উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে সহজলভ্য করা হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে পোলিও নির্মূল এবং মা ও শিশুদের ধনুষ্টঙ্কার দূরীকরণ কার্যক্রম শুরু হয়। ইপিআইতে নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি ২০১২ সাল থেকে ১৫ মাস বয়সী সব শিশুকে হামের দ্বিতীয় ডোজ টিকা সংযোজন করা হয়। পরে ২০১৫ সালে ১৫ মাস বয়সী সব শিশুকে হাম-রুবেলার দ্বিতীয় ডোজ সংযোজন করা হয়।

একই বছর এক বছরের কম বয়সী শিশুদের নিউমোনিয়া ভ্যাকসিন এবং ইনঅ্যাক্টিভেটেড পোলিও ভ্যাকসিন সংযোজন করা হয়। জরায়ু ক্যানসার প্রতিরোধে ইপিআই কর্মসূচিতে এইচপিভি ভ্যাকসিন সংযোজনের জন্য ২০১৬ সাল থেকে গাজীপুরে এইচপিভি ডেমোনেস্ট্রেশন প্রোগ্রাম শুরু হয়ে ২০১৭ সালে তা সম্পন্ন হয়। টিকা বীজের গুণগত মান যথাযথভাবে সংরক্ষণে ১৫টি জেলায় ইপিআই স্টোর নির্মাণ করেছে সরকার। চলতি বছর থেকে ১৫-৪৯ বছর বয়সী সন্তান ধারণক্ষম সব নারীকে টিটি টিকার পরিবর্তে টিডি টিকা কর্মসূচিতে সংযোজিত হয়।

ইপিআইয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব রোগের টিকা দেওয়া হচ্ছে, সেসব রোগে শিশুমৃত্যুর হার অনেক কমে গেছে। টিকাদান কর্মসূচি শুরুর আগে দেশে প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ শিশু ছয়টি রোগে মারা যেত। বর্তমানে শিশুমৃত্যুর হার কমায় তা দেশের সার্বিক শিশুমৃত্যুর হার কমাতেও সহায়তা করছে।

সরকারের একান্ত প্রচেষ্টায় শহর, গ্রাম, প্রত্যন্ত অঞ্চলের সবাই এখন জানে শিশুকে টিকা দিতে হবে। মায়েরা এখন নিজ উদ্যোগেই তাঁদের সন্তানকে নিয়ে টিকাকেন্দ্রে চলে আসেন। শিশুর টিকাদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। টিকাদান কর্মসূচিতে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। এই সাফল্য আমাদের ধরে রাখতেই হবে।

Exit mobile version