গবেষণায় দেখা গেছে প্রকৃতি মানসিক যন্ত্রণা কমাতে সাহায্য করে।
ইট-কাঠ-পাথরের জঙ্গলে থাকতে থাকতে মানুষের মন বিষিয়ে ওঠে। বিভিন্ন ধরনের মানসিক চাপ সামলিয়ে ওঠার জন্য জন্য যখন মানুষ নানান কিছু করে তখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সপ্তাহের কয়েকটা দিন কিছু সময় প্রকৃতির মাঝে কাটাতে পারলে মানসিক যন্ত্রণা অনেকটা কমে আসবে।
সেটা হতে পারে পার্কে গিয়ে হাঁটা কিংবা ২০ থেকে ৩০ মিনিট গাছগাছালির সংস্পর্শে শুধুই বসে থাকা।
২০১৯ সালে ‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন সাইকোলজি’তে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়, প্রকৃতির মাঝে ২০ মিনিট কাটাতে পারলে ‘স্ট্রেস হরমোন’য়ের মাত্রা পাখির পালকের মতো উড়ে যায়।
গবেষকদের করা এই পর্যবেক্ষণের জন্য ৪০ জন অংশগ্রহণকারীকে প্রকৃতির মাঝে কাটাতে বলা হয়। অন্তত ১০ মিনিট করে সপ্তাহে তিন দিন দুই মাস ধরে তারা কেউ হেঁটেছেন কেউবা বসে থেকেছেন প্রকৃতির মাঝে। এর আগে তাদের মানসিক চাপের জন্য নিঃসৃত ‘কর্টিসল’ হরমোনের মাত্রা মেপে রাখা হয়।
‘হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল’য়ের এই পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, প্রকৃতির মাঝে ২০ থেকে ৩০ মিনিট কাটাতে পারলে ‘কর্টিসল’ হরমোনের মাত্রা কমে আসে। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য মানসিক চাপগুলোও কামতে থাকে।
তাই এরপর কোনো মানসিক চাপ অনুভব করলে গাছগাছালি ঘেরা জায়গা খুঁজে নিয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর চেষ্টা করা যেতেই।
প্রাকৃতিক ব্যথা নিরাময়ক
ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটা’র বিশেষজ্ঞদের মতে, “প্রকৃতি আমাদের যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিতে সাহায্য করে।”
‘মাইন্ড অ্যান্ড বডি’ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে আরও জানায়, “কারণ আমরা সৃষ্টিগতভাবেই গাছ, পানিসহ অন্যান্য প্রকৃতিক উপাদান খুঁজে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রোগ্রাম করা। প্রকৃতির সুধা গ্রহণ করার মধ্যে দিয়ে আমাদের জ্বালা যন্ত্রণা বের করে দিতে পারি।
প্রকৃতির রয়েছে সারিয়ে তোলার ক্ষমতা। ১৯৮০ সালে ‘সায়েন্স’ সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘পেনসালভিনিয়া হসপিটাল’য়ের করা পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অস্ত্রচিকিৎসার পর যারা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতো তাদের তুলনায় যারা স্বাভাবিকভাবে গাছের দিকে তাকিয়ে ছিলেন তারা দ্রুত আরগ্য লাভ করেছেন।
প্রকৃতি মানুষকে মিশুক করে
‘ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয়’য়ের গবেষকদের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, শহুরে মানুষ যারা গাছগাছালি ঘেরা পরিবেশে বাস করে তারা বেশি অতিথিপরায়ন হয় অন্যদের তুলনায়; বিশেষ করে যাদের আশপাশে প্রকৃতির ছোঁয়া নেই।
যারা সবুজের সান্নিধ্যে রয়েছে তাদের বেশি মানুষের সঙ্গে চেনা-জানা রয়েছে, প্রতিবেশির সঙ্গে যোগাযোগ বেশি, নিজেদের মধ্যে বন্ধন দৃঢ়।
ঘুম হয় ভালো
‘আলস্টার ইউনিভার্সিটি’র ‘আলস্টার ডক্টোরাল কলেজ’য়ের পোস্টগ্র্যাজুয়েট গবেষক ও পরিচালক অধ্যাপক মারি মার্ফির মতে, “সকালে হাঁটতে গেলে, সূর্যের আলো দেহঘড়িকে ঠিকঠাক কাজ করতে সাহায্য করে। যার ফলাফল হল রাতে ভালো ঘুম।”
“কারণ আমাদের দেহঘড়ি ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলে। তাই প্রতিদিন ভোরে এই ঘড়ি পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ জরুরি। ভোরের নীল আলো সেটা করতে সাহায্য করে।” বলেন যুক্তরাজ্যের চিকিৎসক মাইকেল মোজলে।
বিবিসি রেডিও ফোর’য়ের পডকাস্টে তিনি আরও বলেন, “দেহের অভ্যন্তরে যে ঘড়ি কাজ করে যাচ্ছে তা ঠিকঠাক চলার মতো আলোর সাহায্য দরকার। তাছাড়া আলোর সংস্পর্শে আসলে ‘মেলাটনিন’ উৎপাদন দমিয়ে রাখে। এই হরমোন আমাদের ঘুমতে যেতে উৎসাহ দেয়।”
তাই ভোরের আলোতে ঘুম যেমন আসবে না, তেমনি সন্ধ্যার পর আলোর সংস্পর্শে যত কম আসা যাবে ততই ভালো ঘুম হবে। আর এভাবে চালিয়ে গেলে একসময় ভোরে উঠতেও সমস্যা হবে না।
নেতিবাচক চিন্তাভাবনার দমন
লন্ডনের ‘নেচার থেরাপি স্কুল’য়ের প্রতিষ্ঠাতা বেথ কলিয়ার ‘দি গার্ডিয়ান’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমরা যখন প্রকৃতির মাঝে হাঁটতে যাই তখন মস্তিষ্কের যে অংশ নেতিবাচক চিন্তাভাবনার উত্তরণ ঘটায়, প্রকৃতির সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার কারণে সেটা চুপচাপ হয়ে যায়।”
তিনি আরও বলেন, “যা আমাদের সমস্যাগুলো সঠিকভাবে সমাধান করার জন্য সময় দেয়।”
তাই এরপর থেকে যতই মন খারাপ হোক বা অবসাদগ্রস্ততায় ঘিরে ধরুক, প্রকৃতির মাঝে কাটানোর চেষ্টা করতে হবে। সেটা হতে পারে নদী বা পুকুর পাড় কিংবা শহরের কোনো পার্ক।