স্লিপ অ্যাপনিয়া বা ঘুমের মধ্যে শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যাঘাত ঘটা বিরল কোন রোগ নয়। তবে সাধারনভাবে আমরা এই সমস্যাটির গুরুত্ব বুঝতে পারি না। আপনার পরিবারে যদি এমন কেউ থাকে যে ঘুমের মধ্যে নাক ডাকে, সারাদিন ক্লান্ত বোধ করে, তবে এটি হতে পারে স্লিপ অ্যাপনিয়ার লক্ষণ- তার চিকিৎসার উদ্যোগ নিতে হবে দ্রুত।
ঘুমের মধ্যে কিছু সময়ের জন্য শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া – চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় স্লিপ অ্যাপনিয়া – একটি রোগ এবং চিকিৎসকেরা মনে করেন যে এটি মানুষের জন্য একটি গুপ্তঘাতক।
ভারতীয় মিউজিশিয়ান বাপ্পী লাহিড়ীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়েছে ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার সবচেয়ে সাধারণ ধরন অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়াকে।
কিন্তু এই রোগটি সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা কম। এই রোগে ভুগলেও অনেক সময় ভূক্তভোগী বুঝতে পারেন না। ঢাকায় চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশেও স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা উদ্বেগ জনক হারে বেড়ে চলেছে।
স্লিপ অ্যাপনিয়া কী?
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া ঘটে যখন আপনার গলার পেশি মাঝে মাঝে শিথিল হয়ে যায়। এর ফলে ঘুমের মধ্যেই আপনার শ্বাসনালী ব্লক হয়ে যেতে পারে। এর প্রধান লক্ষণ হলো নাক ডাকা। অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার আরও কয়েকটি লক্ষণ আছে, সেগুলো হলো-
>> দিনের বেলা অত্যধিক ঘুম ঘুম ভাব
>> ঘুমের সময় শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ায় হঠাৎ জেগে ওঠা
>> হাঁপানি ও বা দম বন্ধ হয়ে যাওয়া
>> যে কোনো কাজে মনোযোগের অভাব
>> মেজাজ পরিবর্তন যেমন- বিষণ্নতা বা বিরক্তি
>> উচ্চ রক্তচাপ
>> লিবিডো কমে যাওয়া ইত্যাদি।
এই রোগে আক্রান্তের অভিজ্ঞতা কেমন
ঢাকায় একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত একজন নারী এই রোগের জন্য নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন গত দুই বছর ধরে। নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষাজীবনে তার উচ্চতার তুলনায় শরীরের ওজন অনেক বেড়ে যায়। তখন ঘুমের মধ্যে নাক ডাকা এবং জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়ার বিষয়টি তিনি বুঝতে পারেন।
- কিন্তু ওই সময়ে তার দম বন্ধ হয়ে যেতো না।
- রোগীর ঘুম পরীক্ষা করে স্লিপ অ্যাপনিয়ার নির্ণয় করা সম্ভব।
- তবে বছর তিনেক আগে এক রাতে ওই নারী টের পান যে হঠাৎ করে তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ফলে তার ঘুম ভেঙে যায় এবং তিনি হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসেন।
- এরপর মাঝে মাঝেই এমন পরিস্থিতিতে তার ঘুমের ব্যাঘাত হতো।
- আরেক রাতে তার একেবারে ভিন্ন ধরনের এক অভিজ্ঞতা হয়।
- ওই নারী বলছিলেন যে ঘুমের মধ্যে হঠাৎ তার দম বন্ধ হয়ে গেলে তার ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু তিনি অনুভবন করেন, বিছানায় শোয়া অবস্থা থেকে তার উঠে বসার এবং এমনকি কথা বলার শক্তি নেই।
- বেশ কিছুটা সময় পর তার শ্বাস-প্রশ্বাস ফিরে এলে তিনি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হন।
- এরপর তিনি দুই বছর ধরে চিকিৎসা করাচ্ছেন। তিনি ব্রেন বা নিউরো সমস্যা থেকে অ্যাপনিয়ায় ভুগছেন – এমনটাই চিকিৎসক চিহ্নিত করেছেন।
- এখন তিনি নিয়মিত চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা ভাল আছেন। তবে তাকে আজীবন চিকিৎসা নিতে হবে।
স্লিপ অ্যাপনিয়া কত ধরনের হয়
নাক কান গলা রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ জানিয়েছেন, অবস্ট্রাকশন বা শ্বাস প্রশ্বাসের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হলে তাকে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া বলা হয়।
গলায় টনসিল ফুলে গিয়ে এমনটা হতে পারে। শ্বাসনালী এবং গলার সংযোগ স্থলে অনেক সময় মাংসপেশী ফুলে যায়, যেটাকে অ্যাডনয়েড বলা হয়। এছাড়া অনেক সময় নাকের ভেতরে মাংসপেশী বড় হয়ে যায়।
এই সমস্যাগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসে বাধা সৃষ্টি করে, যাকে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ওজন বেশি বা শরীরে মেদ বেশি রয়েছে, এমন বয়স্ক মানুষ ও শিশু এই অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ায় বেশি ভোগে।
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ জানিয়েছেন, হৃদপিন্ড, ব্রেন এবং নিউরো সমস্যা থেকে একজনের শরীরের সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমে নানা ধরনের জটিলতা হয় এবং তখন ওই ব্যক্তি স্লিপ অ্যাপনিয়ায় ভুগতে পারেন। এই সমস্যা অনেক সময় জটিল এবং গুরুতর হয়।
তবে দুই ধরনের অ্যাপনিয়াতেই মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে।
যেভাবে নির্ণয় করা যায়
এ ব্যাপারে পাশের মানুষের সচেতনতার ওপর গুরুত্বারোপ করে অধ্যাপক ডা. মো. বিল্লাল আলম বলেন, স্বামীর বেড পার্টনার থাকে, অর্থাৎ স্ত্রী বলতে পারবে, স্ত্রীর যদি থাকে স্বামী বলতে পারবে। যেমন: ঘুমের মধ্যে অনেক নাক ডাকা। লাফ দিয়ে ঘুম থেকে ওঠে যাওয়া। এ রকম একবার, দুইবার, শতবার ঘুম থেকে ওঠে। মাঝে মধ্যে ঘুম থেকে ওঠে সোফায় চলে যাওয়া। ড্রয়িং রুমে বসে থাকা। সারারাত এ রকম ২০ বার ২৫ বার কিংবা শতবার যদি ওঠে। অবশ্যই তার দেহের বিভিন্ন সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ক্ষতিটা তার শরীরের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির।
নাক ডাকা মানেই কী স্লিপ অ্যাপনিয়া?
অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেছেন, ওজন বেশি হলে ঘুমের সময় শ্বাসনালীকে ঘিরে গলা এবং আশেপাশের জায়গাগুলো সরু হয়ে যায়। এছাড়া নাকের মাংসপেশী অনেক সময় বড় হয়ে যায়।
এসব ক্ষেত্রে ঘুমের মধ্যে মুখ দিয়ে হা করে নিঃশ্বাস নিতে হয় এবং তখন নাক ডাকার শব্দ হয়।
তাই নাক ডাকলেই তাকে স্লিপ অ্যাপনিয়া বলা যায় না।
স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির দম বন্ধ হয়ে বার বার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে।
তবে স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্তরাও নাক ডাকে।
তাদের ঘুমের মধ্যে সাধারণত জোরে জোরে শ্বাস নিতে হয় এবং দম আটকে আসায় ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে।
স্লিপ অ্যাপনিয়ার চিকিৎসা কী?
আসলে স্লিপ অ্যাপনিয়ার চিকিৎসা নির্ভর করে কোন কারণে এটি ঘটছে তা নির্ণয়ের মাধ্যমে। সাধারণত নাক, কান ও গলার কোনো গঠনগত ত্রুটি থাকার কারণে এ সমস্যা হলে সেটির পুনর্গঠনমূলক অস্ত্রোপচার (রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারি) করান চিকিৎসকরা।
অনেকের আবার স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজনের কারণে স্লিপ অ্যাপনিয়া হয়। যা ওজন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সারানো সম্ভব। তবে স্লিপ অ্যাপনিয়ার সমস্যা হয়ে থাকলে তা পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
অন্যান্য সমস্যার মতোই স্লিপ অ্যাপনিয়াও একটি রোগ। এতে মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে বরং সতর্ক থাকতে হবে। এই রোগে চিকিৎসা নিলে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায়।
আর চিকিৎসা না নিলে রোগীর জীবনে নানা রকম জটিলতার সৃষ্টি হয়। এই রোগটি পুষে রাখলে স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগীর উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের (স্ট্রোক) ঝুঁকি বাড়ে।
প্রতিরোধ করা কী সম্ভব?
চিকিৎসকরা মনে করেন যে সতর্ক থাকলে এই রোগ এড়ানো সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে কিছু ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়ে তাকেন তারা।
প্রথমত, শরীরের উচ্চতা অনুযায়ী ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
দ্বিতীয়ত, নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।
আর তৃতীয়ত, সুষম খাদ্যাভাস করতে হবে।
এছাড়া ঘুমের মধ্যে বার বার দম বন্ধ হয়ে এলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে ভাল থাকা সম্ভব বলে জানান চিকিৎসকেরা।