হাঁপানি একটি জটিল রোগ। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরও ভালো থাকা যায়। সেজন্য মানতে হবে নিয়ম। ছকে আকা জীবনে থাকলে হাঁপানিতেও ঝুঁকিমুক্ত থাকা যায়।
হাঁপানি হলে কী করবেন কী করবেন না সে বিষয়ে যুগান্তরকে পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক অ্যালার্জি ও অ্যাজমা রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. গোবিন্দ চন্দ্র দাস।
হাঁপানির আক্রমণ শুরু হওয়ার লক্ষণ
* কাশি
* শোঁ শোঁ শব্দ
* বুকে চাপ সৃষ্টি
* রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া
যে জিনিস থেকে শুরু হয়েছে সেটি থেকে দূরে সরে যান। সালবুটামলজাতীয় ওষুধের ইনহেলার ব্যবহার করুন প্রয়োজনে ৫ মিনিট পর পর। শান্ত থাকুন, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হওয়ার জন্য অপেক্ষা করুন।
যদি এতেও ভালো না হন তাহলে ডাক্তারের কাছে জরুরি সহায়তার জন্য যান। যদি হাঁপানির এ বিপদ সংকেতগুলোর কোনো একটি দেখেন তাহলে সাহায্য নিন।
* আপনার চটপট আরামের ওষুধ যদি খুব বেশিক্ষণ কাজ না করে বা তাতে একেবারেই উপকার না হয়
* শ্বাস-প্রশ্বাস যদি দ্রুত ও জোরে জোরে হয়
* যদি কথা বলতে কষ্ট হয়
* ঠোঁটে বা আঙুলের নখ নীল বা ছাইরঙের হয়ে যায়
* পাঁজরের চারপাশে ও বুকের নিচের চামড়া শ্বাস নেয়ার সময় ভেতর দিকে টেনে ধরে
* হঠাৎ স্পন্দন বা নাড়ির গতি অত্যন্ত দ্রুত হয়, হাঁটা চলা করতে কষ্ট হয়।
যেসব জিনিস থেকে হাঁপানির আক্রমণ শুরু হয় সেগুলো বাড়ি থেকে দূরে রাখুন। এজন্য হাঁপানি রোগীদের অ্যালার্জি পরীক্ষা করে জানা দরকার তার কোন দ্রব্যাদি থেকে অ্যালার্জি শুরু হয়।
হাঁপানি রোগে আক্রান্ত অনেকেরই পশুপাখির লোমে অ্যালার্জি থাকে তাই এসব প্রাণী বাড়ির বাইরেই রাখুন।
বিছানা করুন প্লেন লিনের দিয়ে। প্রতিদিন দু’বেলা ঘরের মেঝে পরিষ্কার করা দরকার। রোগীর বিছানার চাদর প্রতিদিন ধুয়ে ব্যবহার করতে হবে অথবা প্রতিদিন রোদে শুকাতে হবে। যেসব জিনিস থেকে ধুলো উড়ে সেগুলো নাড়াচাড়া করবেন না। এসব ঝাড়ার সময় রোগীকে ঘরের বাইরে থাকতে হবে। কোনোও ঝাঁঝালো গন্ধ যেমন- মসলার গন্ধ, মশা মারার স্প্রে, পারফিউম যেন নাকে প্রবেশ না করে।
ধুলো, ধোঁয়া ঠাণ্ডা বা কুয়াশা শরীরে লাগানো চলবে না। রাস্তার ধুলো, ঘরের পুরনো ধুলো, গাড়ির ধোঁয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ফিল্টার মাস্ক ব্যবহার করুন। যারা বাইক অথবা নন এসি গাড়ি চালান তারা অবশ্যই মাস্ক পরে নেবেন।
ধূমপান বারণ : সিগারেটের ধোঁয়া হাঁপানির কষ্ট মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে দেয়। শুধু হাঁপানিই নয় ফুসফুস ও শ্বাসনালিসংক্রান্ত অনেক অসুখের অন্যতম কারণ ধূমপান। সিগারেটের ধোঁয়া থেকে প্রথমে ব্রঙ্কাইটিস, পরে ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস সৃষ্টি হয়। হাঁপানি রোগী নিজে তো ধূমপান করবেই না উপরন্তু যে ঘরে হাঁপানি রোগী থাকে সেখানেও কোনো স্মোকারের প্রবেশ নিষেধ। কারণ পরোক্ষ ধূমপানও হাঁপানির কষ্ট অনেকটা বাড়িয়ে দেয়।
শোয়ার ঘর রদবদল করুন : ঘর থেকে কার্পেট বের করে দিন। এগুলোতে প্রচুর ধুলা জমে। নরম চেয়ারকুশন ও বাড়তি বালিশও বের করে দিন। এগুলোতেও ধুলা জমে। তোষক ও বালিশে চেনটানা বিশেষ ধুলো রোধক ঢাকা ব্যবহার করুন, তা না থাকলে অন্তত পাতলা রেক্সিনের কাভার দিন।
পরিষ্কার ও খোলা হাওয়ার জন্য জানালা খোলা রাখুন। ভ্যাপসা ও দমবন্ধ লাগলে জানালাগুলো খুলে দিন, এমনকি রান্না করার সময় ধোঁয়া উঠলে উগ্র গন্ধ ছড়ালেও তা করতে পারেন। কাঠ বা কেরোসিনে রান্না করলে ধোঁয়া বেরিয়ে যাওয়ার জন্য একটা জানালা অল্প খুলে রাখুন। যখন বাইরে গাড়ির ধোঁয়া, ফ্যাক্টরির দূষণ, ধুলো বা ফুল ও গাছের রেণু বেশি থাকে, তখন জানালা বন্ধ রাখুন।
ব্যায়াম করুন : প্রতিদিন নিয়ম করে হালকা ব্যায়াম করা খুব জরুরি। তবে একটা কথা ভুললে চলবে না বেশি ব্যায়ামের জন্য যেন হাঁপানির টান না ওঠে। হাঁটা, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালান এগুলো কিন্তু হাঁপানি রোগীদের পক্ষে ভালো ব্যায়াম। হাঁটার সময়ে সামনে ঝুঁকে হাঁটবেন না। শিরদাঁড়া সোজা রেখে প্রতিদিন ২/৩ কিলোমিটার উন্মুক্ত বাতাসে সমতলে হাঁটুন। এর সঙ্গে করা দরকার প্রাণায়ামজাতীয় গভীর শ্বাস নেয়ার আসন। যেমন- ধীরে ধীরে শ্বাস টানতে হবে, যতক্ষণ নেয়া যায়, তারপর যতক্ষণ সম্ভব শ্বাস আটকে রাখতে হবে এবং তারপর ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়তে হবে। বাচ্চাদের ব্যায়াম ও খেলাধুলার সময়ে সতর্ক দৃষ্টি রেখে দেখা উচিত যে ওদের কোনো অসুবিধা বা শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কিনা। মাঠে খেলার আগে ওষুধ দিয়ে দিতে হবে।
টেনশন মুক্ত থাকতে হবে : কোনো কারণে ভয় পেলে, মানসিক উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা বা শোক থেকেও হাঁপানির টান হতে পারে। তাই মনটাকে রাখতে হবে টেনশন ফ্রি, শরীর মন শিথিল করে দেয়া রপ্ত করতে হবে।
হাঁপানি রোগীর অনুপস্থিতিতে কয়েকটি কাজ সেরে রাখুন। ঘরদোর মুছে, ভ্যাকুয়াম করে বা ঝাঁট দিয়ে রাখুন, পোকা মাকড়ের জন্য স্প্রে করুন, কড়া গন্ধযুক্ত রান্নাবান্না সেরে রাখুন, ঘরে ফেরার আগে হাওয়া প্রবেশ করতে দিন।
পানি : হাঁপানির চিকিৎসা চলাকালীন রোগীকে প্রচুর পরিমাণ পানি খেতে হবে। কারণ শরীরে পানির ঘাটতি থাকলে হাঁপানির ওষুধ কাজ করে না। এছাড়া পানির অভাবে কফ জমে যায় ও সহজে বেরোতে পারে না, ফলে শ্বাসকষ্ট আরও বেড়ে যায়।
খাওয়া-দাওয়া : বেশি রাতে ভরপেট খেলে হাঁপানির টান উঠতে পারে। তাই রাতে পেট ভরে ভুলেও খাবেন না। হাঁপানি রুখতে নিয়ম করে হাতে কিছুটা সময় নিয়ে খেতে হবে, অকারণে তাড়াহুড়া করা চলবে না, ঝাল মসলার খাবারের বদলে হালকা রান্না করা বাড়ির খাবার খাওয়াই বাঞ্ছনীয়। ফ্রিজ থেকে বের করে সঙ্গে সঙ্গে জিনিস খাওয়া উচিত নয়। রুম টেম্পারেচারে এলে তবেই খাবেন, ঠাণ্ডা কোল্ড ড্রিঙ্কস বা ফ্রিজের পানি প্রচণ্ড গরমেও খাওয়া উচিত নয়।
ঘরের তাপমাত্রা : শীতকালে ঘর গরম রাখতে পারলে ভালো হয়। ঘরে বাতানুকূল যন্ত্র থাকলে অনেক সময় ধুলা ময়লার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। কিন্তু তাই বলে বাতানুকূল ঘরের বাইরে বারবার যাতায়াত করা উচিত নয়। যন্ত্রের হাওয়াটা যেন সোজাসুজি গায়ে এসে না লাগে এটাও দেখা প্রয়োজন।
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ ব্যবহার করবেন। অনেক সময় ডাক্তার ইনহেলার প্রেসক্রিপশন করেন, কিন্তু রোগী বা রোগীর অভিভাবকরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে থাকেন, এটা ব্যবহার করবেন কি করবেন না। মনে করেন এটা একবার ব্যবহার করলে সারা জীবন নিতে হবে।
বিশেষ করে যখন ১ বছরের নিচের বাচ্চাদের দেয়া হয়। বর্তমানে উন্নত বিশ্বে সর্বত্রই ইনহেলার ব্যবহার হচ্ছে। এতে ওষুধের পরিমাণ কম লাগে এবং কাজও হয় তাড়াতাড়ি। একবার ইনহেলার ব্যবহার করলে সারাজীবন সেটা নিতে হবে এ ধারণাটাও ঠিক না।
তাছাড়া রোগীদের চিকিৎসায় অ্যালার্জির ধরন অনুযায়ী ডাক্তার ভ্যাকসিন দিলে আর তা ঠিকমতো দিতে হবে। অনেকে ভ্যাকসিন নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে থাকেন। এটাও আধুনিক চিকিৎসার একটা অংশ। দীর্ঘদিন সুস্থ থাকতে এর কোনো বিকল্প নেই।